বাংলাদেশে ভিপিএন ব্যবহার কি ঝুঁকিপূর্ণ
এই লেখার শিরোনামে দুটি প্রশ্ন রয়েছে। এই দুই প্রশ্নের প্রেক্ষাপট ও উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক। বাংলাদেশে ভিপিএন বা ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা কি অবৈধ বা বেআইনি? এককথায় এর উত্তর হলো না। দেশে এখনো ভিপিএনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়নি। কিংবা প্রযুক্তিগত কারণে এর ব্যবহার বন্ধ করারও উপায় নেই। শিরোনামের দ্বিতীয় অংশটি হচ্ছে ইন্টারনেট দুনিয়ায় যুক্ত থেকে ভিপিএন ব্যবহার কি ঝুঁকিপূর্ণ? এর উত্তরও নেতিবাচক।
এই সময়ে এসে এই দুই প্রশ্ন অনেকের মাথাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে। কারণ দেশের বর্তমান চলমান পরিস্থিতি। ১০ দিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকার পর এটি চালু করা হয়েছে। তবে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, বার্তা আদান-প্রদান ও কল করার অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপ মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে ঘোষণা দিয়ে বন্ধ রেখেছে সরকার।
স্বাভাবিক প্রচলিত পথ যখন রুদ্ধ থাকে তখন বিকল্প পথে চলতে হয়। এটা স্বাভাবিক। প্রযুক্তি, বিশেষ করে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে ‘বিকল্প’ রয়েছে অনেক। প্রযুক্তির স্বাভাবিক প্রবাহ এই যুগে রুদ্ধ করে রাখার উপায় নেই বললেই চলে। ফেসবুকসহ কয়েকটি মাধ্যম শ্রেণি-পেশা-বয়স-লিঙ্গনির্বিশেষে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের নিত্যসঙ্গী বলা যায়। যোগাযোগ, প্রাতিষ্ঠানিক কাজ, ব্যবসা-উদ্যোগ, প্রচারের জন্য বর্তমান যুগে এই মাধ্যমগুলোর ওপর অসংখ্য মানুষ নির্ভরশীল। বড় কথা হলো অভ্যস্ততা। তাই ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক বা হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করতে মানুষ বিকল্প বেছে নেবেই। সেই বিকল্প হলো ভিপিএন। নির্দিষ্ট একটি ভৌগোলিক অঞ্চলে এই মাধ্যমগুলোর প্রবেশ বা এগুলোতে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে রাখা হলে ভিপিএনের ব্যবহার দেখা যায়। কেননা, ভিপিএন ইন্টারনেট প্রটোকল ব্যবহার করে অন্য একটি দেশ বা অঞ্চলের সঙ্গে একটি ভার্চ্যুয়াল নেটওয়ার্ক গড়ে দেয়। সেই অঞ্চলে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ নয়। ফলে সার্ভার যখন দেখে ব্যবহারকারী বন্ধ বা ব্লক করা কোনো নেটওয়ার্ক থেকে আসেনি, তখন তাকে সেই সাইটে প্রবেশ করতে দেয়। এ কারণেই বিশেষ বিশেষ সময়ে ভিন্ন ভিন্ন কারণে ভিপিএন অ্যাপ বা সেবাগুলো জনপ্রিয়তা পায়।
গত কয়েক দিনে বাংলাদেশ থেকে ভিপিএন ব্যবহারের হার পাঁচ হাজার গুণ বেড়েছে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলকও এই তথ্যের উল্লেখ করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আইসিটি টাওয়ারে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে আয়োজিত এক পর্যালোচনা সভায় প্রতিমন্ত্রী দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ভিপিএন ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, তিনি বলেছেন ভিপিএন থেকে বিরত থাকি। তথ্য সুরক্ষার জন্য বিরত থাকি। ভিপিএন যে দিচ্ছে, সে পুরো তথ্য–উপাত্ত পাচ্ছে। ভিপিএন চালু রেখে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আর্থিক লেনদেন করলে গুরুত্বপূর্ণ সংবেদনশীল তথ্য অন্যের কাছে চলে যেতে পারে। ভিপিএন ব্যবহার সাইবার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলেও জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, ব্যাংক ও তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের সাইবার হামলার ঝুঁকিতে আছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মদদে দেশে সাইবার হামলার অপচেষ্টা চলছে।
একটা বিষয় সহজেই বোঝা যায়, বাংলাদেশ থেকে এখন কেন এত ভিপিএনের ব্যবহার হচ্ছে। এর মূল কারণ ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো দেশে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। জুনাইদ আহ্মেদ পলক সরকারের পক্ষে নিজেই এই ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও তিনি নিজে ফেসবুক, টিকটকে সক্রিয়। আর সাধারণ মানুষ যেহেতু বিকল্পের সন্ধান পেয়েছে, তাই ভিপিএন দিয়ে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটক তারা চালাচ্ছে। বাংলাদেশে বসে ভার্চ্যুয়ালি নিজের অবস্থান ভিন্ন কোনো দেশে দেখিয়ে এই অ্যাপ বা ওয়েবসাইটগুলো দেখছে।
ভিপিএন নিয়ে কথা হচ্ছিল নেটওয়ার্ক বিশেষজ্ঞ ও এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ইনফরমেশন সেন্টার—এপিনিকের নির্বাহী কমিটির সদস্য সুমন আহমেদ সাবিরের সঙ্গে। তিনি প্রথমে জানালেন ভিপিএন একটি বৈধ প্রযুক্তি। বললেন, ভিপিএন ব্যবহার করা হয় নিরাপদে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে ও তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। ধরা যাক গুলশান ও ধানমন্ডিতে একই অফিসের দুটি শাখা রয়েছে। কিংবা ঢাকা ও চট্টগ্রাম বা দুই দেশে দুটি শাখার মধ্যে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। ভৌত কাঠামো বা তারের মাধ্যমে এই নেটওয়ার্ক তৈরি খুবই ব্যয়বহুল, ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভবও বটে। তাই ইন্টারনেটকে ভিত্তি করে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়। সেটাই ভার্চ্যুয়াল নেটওয়ার্ক। প্রাইভেট মানে ব্যক্তিগত। অর্থাৎ ইন্টারনেট প্রটোকলভিত্তিক যে নেটওয়ার্কটি গড়ে উঠল, সেটি নির্দিষ্ট কাজের জন্যই ব্যবহৃত হবে। পাবলিক বা উন্মুক্ত নেটওয়ার্কের সঙ্গে এটি যুক্ত থাকবে না। ফলে ফাইল বা তথ্য আদান-প্রদান করা যায় নিজেদের নিয়ন্ত্রিত নিরাপদ এক মাধ্যমে। তাই তো সুমন আহমেদ বললেন, ভিপিএনের মূল উদ্দেশ্য হলো সাইবার জগতে নিরাপত্তা দেওয়া। ভিপিএন সাইবার ঝুঁকি বাড়ায় না বরং কমায়।
ফেসবুকে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ
অনেক ধরনের ভিপিএন এখন ইন্টারনেটে প্রচলিত। এর মধ্যে আছে বাণিজ্যিক ভিপিএন যেগুলো অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করা যায়। কিছু আবার ট্রায়াল মেয়াদে বিনা মূল্যে ব্যবহার করা যায়। কোনটা কী ধরনের নিরাপত্তা দিচ্ছে, তা সেই ভিপিএনগুলোর কারিগরি বর্ণনা থেকে বোঝা যায়। কিছু আছে স্বেচ্ছাসেবী ভিপিএন। কোনো দেশের ইন্টারনেট অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিভিন্ন সংস্থা বিনা মূল্যে ভিপিএন সেবা দিয়ে থাকে। মূলত বাণিজ্যিক ও স্বেচ্ছাসেবী ভিপিএনগুলোই সাধারণ মানুষ ব্যাপক হারে ব্যবহার করে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো দেশে যখন কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ওয়েবসাইট বন্ধ বা ব্লক থাকে, তখন ব্যবহারকারী ভিপিএনের মাধ্যমে নিজের ভার্চ্যুয়াল অবস্থান অন্য কোনো দেশে দেখিয়ে ওই সব সাইটে প্রবেশ করতে পারেন।
এটা সত্য যে ভিপিএন ব্যবহার করতে ইন্টারনেটের বেশি ব্যান্ডউইডথের প্রয়োজন হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেটাও ১০ শতাংশের বেশি না। আর ব্যবহারকারী ব্যান্ডউইডথ তথা ইন্টারনেট তো নিজের টাকায় কিনে ব্যবহার করেন। এতে আর্থিক ক্ষতি হলে তার হবে, অন্য কারও নয়। ভিপিএন ব্যবহার করে কেউ প্রতারণা করতে পারে, এ ধরনের সাইবার প্রতারণা বা সাইবার হামলা ওয়েবসাইট বা সফটওয়্যারের মাধ্যমেই হতে পারে। সে রকম হাজারো উদাহরণ, ঘটনা আমরা দেখি।
আর্থিক লেনদেনের অ্যাপ্লিকেশনগুলোর বিশেষ নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকে। সেটি ভাঙতে পারলে ঝুঁকি তৈরি হয়। এখানে ভিপিএনের ঘাড়ে দোষ চাপানোর কোনো মানে নেই। যেমন ভিপিএন চলার সময় দেশের বিকাশ বা নগদ অ্যাপ খুললে সেগুলো খোলে না। ভিপিএন শনাক্ত হয়েছে—এ রকম বার্তা দেয়।
বড় কথা হলো ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো খুলে দিলে মানুষের তো আর ভিপিএন ব্যবহার করে এসব সাইটে বা অ্যাপে যেতে হবে না। আসলে সমস্যা কোনটা নিয়ে, ভিপিএন না সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। প্রতিমন্ত্রী নিজে প্রায়ই বলেন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের দিকে যাত্রা শুরু করেছি। এখন তিনিই যদি প্রযুক্তি নিয়ে এমন কথা বলে ছেলে ভোলানো জুজুর ভয় দেখান, সেটা তো ঠিক গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে না।