আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে মাঠে যৌথবাহিনী জমা দেননি আওয়ামী লীগের ৫২ নেতা-কর্মী
সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কক্সবাজারে অস্ত্র জমা দেননি আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলোর অন্তত ৫২ নেতা-কর্মী। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী আত্মগোপন করেন। নেতাদের মধ্যে অনেকে বিদেশে পালিয়ে গেছেন বলে খবর রয়েছে। এ কারণে অনেকের পক্ষে লাইসেন্স করা অস্ত্র জমা দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের কয়েকজন নেতা। তবে অস্ত্র জমা না দেওয়ার তালিকায় বিএনপি সমর্থক কয়েকজনের নামও রয়েছে।
জেলা প্রশাসনের জে এম শাখার তথ্যমতে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে চলতি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত কক্সবাজার জেলা প্রশাসন আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যু করে ২৭৯টি। এসব লাইসেন্সের বিপরীতে ২৩৩টি আগ্নেয়াস্ত্র কেনা হয়। এর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন আগ্নেয়াস্ত্র ২০৫টি। কিন্তু গত মঙ্গলবার পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন থানায় জমা পড়েছে ১০১টি আগ্নেয়াস্ত্র। অবশিষ্ট ১০৪টি আগ্নেয়াস্ত্র জমা পড়েনি। মঙ্গলবার রাত ১২টা পর্যন্ত লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেওয়ার সর্বশেষ সময় নির্ধারণ করা ছিল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকদের মধ্যে অন্তত ৫২ জন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী, যাঁদের অনেকে হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি। তাঁদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে আত্মগোপনে থেকেও দলের কয়েকজন নেতা লোক মারফত নিজেদের আগ্নেয়াস্ত্র জমা দিয়েছেন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আতাউল গণী ওসমানী প্রথম আলোকে বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যাঁরা লাইসেন্সের বিপরীতে কেনা আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেননি, এখন সেসব অবৈধ হয়ে গেছে। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে মাঠে নেমেছে যৌথ বাহিনী।
আত্মগোপনে আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকেরা
কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি (বহিষ্কৃত) জাফর আলমের লাইসেন্স করা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি শটগান রয়েছে। মঙ্গলবার রাত ১১টা পর্যন্ত অস্ত্রটি জমা দেওয়া হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন থেকে তিনি আত্মগোপন করেন।
মহেশখালী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মকসুদ মিয়ার লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে দুটি। একটি বিদেশি পিস্তল, আরেকটি শটগান। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কোনোটি জমা পড়েনি। তিনিও বেশ কিছুদিন ধরে আত্মগোপনে আছেন।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মাছ ব্যবসায়ী সালাহ উদ্দিন আহমদের একটি শটগান থাকলেও জমা হয়নি। তিনি চকরিয়ার বরইতলী এলাকার বাসিন্দা। কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা কায়সারুল হকের আছে একটি শটগান। এ ছাড়া তাঁর বাবার নামে আছে আরেকটি পিস্তল। কোনোটাই জমা পড়েনি। যদিও তাঁর বড় ভাই কক্সবাজার জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শাহীনুল হক মার্শালের লাইসেন্স করা একটি শটগান জমা পড়েছে।
কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রহমান বদির লাইসেন্স করা একটি পিস্তল জমা পড়েনি। তিনি সম্প্রতি র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কক্সবাজার কারাগারে বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। তবে তাঁর অনুসারী ও টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদ একটি শটগান টেকনাফ থানায় জমা দিয়েছেন।
হত্যা, দ্রুত বিচার আইন, ইটভাটা দখলসহ পৃথক পাঁচটি মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপনে আছেন কক্সবাজার-৩ (সদর, রামু ও ঈদগাঁও) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও হুইপ সাইমুম সরওয়ার কমল। এর মধ্যেও লোক মারফত তিনি লাইসেন্স করা একটি শটগান ও একটি পিস্তল রামু থানায় জমা দিয়েছেন। সাইমুমের বেশ কয়েকজন অনুসারীর কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও কেউ জমা দেননি। সাইমুম সরওয়ারও বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন।
সাইমুম সরওয়ারের বড় ভাই ও রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজের লাইসেন্স করা দুটি আগ্নেয়াস্ত্র (একটি শটগান ও একটি পিস্তল) জমা দিয়েছেন রামু থানায়।
কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম জমা দিয়েছেন দোনলা একটি বন্দুক। তাঁর ছোট ভাই ও আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফুল ইসলাম জমা দিয়েছেন একটি রিভলবার। জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ইশতিয়াক আহমদ জমা দেন একটি শটগান ও একটি পিস্তল। একনলা বন্দুক জমা দিয়েছেন বিএনপি নেতা মো. আমীর আলীসহ কয়েকজন।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক, কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুবুর রহমান চৌধুরী, কক্সবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য শাহীন আক্তারও আত্মগোপন করেন। তাঁদের কেউ আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেননি। জেলা প্রশাসনের লাইসেন্সধারী ব্যক্তির তালিকায় উল্লিখিত ব্যক্তিদের নাম নেই। তবে আশেকুল্লাহ রফিকের নামে লাইসেন্স অনুমোদন হলেও তিনি আগ্নেয়াস্ত্র কেনেননি বলে জানা গেছে।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ওসমান গণী বলেন, মঙ্গলবার পর্যন্ত থানায় ১১টি আগ্নেয়াস্ত্র জমা পড়েছে। একটি ব্যাংকের বিপরীতে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র জমা পড়েনি। তা ছাড়া অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের ধরতে এলাকায় অভিযান চলছে।
চকরিয়া থানায় ২৭টি আগ্নেয়াস্ত্র জমা পড়েছে জানিয়ে ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, যাঁরা অস্ত্র জমা দেননি, তাঁদের আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকদের একটি তালিকা হয়েছে। সেনা, র্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে এই তালিকা পৌঁছানো হয়েছে। গতকাল বুধবার গভীর রাত থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হয়েছে। অভিযান পরিচালনার সময় যাঁর কাছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া যাবে, তাঁকেই গ্রেপ্তার করা হবে। তাতে সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যমতে, জেলার মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ, উখিয়া, রামু, ঈদগাঁও, কুতুবদিয়া ও কক্সবাজার সদর উপজেলায় অন্তত সাত হাজার অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে।