সামিটের আজিজ খান এখন সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনী (পাচারের টাকায়)
সিঙ্গাপুরে শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় আছেন বাংলাদেশের সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। বর্তমানে তিনি সে দেশের ৪১তম শীর্ষ ধনী। গত বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নীরিক্ষা ও পরিসংখ্যন অনুযায়ী তার এই অবস্থান তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী ফোর্বস। ফোর্বসে প্রকাশিত ২০২৪ সালের ধনকুবের (বিলিয়নিয়ার) তালিকায় বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের সারিতেই আছেন মুহাম্মদ আজিজ খান। সূত্র খবরের কাগজ।
সর্বশেষ গত ২ এপ্রিল ফোর্বসে প্রকাশিত শীর্ষ ধনকুবের (বিলিয়নিয়ার) তালিকায় ৭৮টি দেশের ২ হাজার ৭৮১ জনের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। তালিকায় ২ হাজার ৫৪৫ নম্বরে রয়েছেন আজিজ খান। যার মোট সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার। আয়ের খাত হিসেবে জ্বালানি খাতের কথা বলা হয়েছে।
ফোর্বসের তথ্য অনুসারে, ৬৮ বছর বয়সী আজিজ খান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। সংগত কারণেই তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছাড়তে হয়েছে। সামিট গ্রুপ বাংলাদেশের একটি শীর্ষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তারা বিদ্যুৎ, বন্দর, ফাইবার অপটিকস, আবাসন ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস নিয়ে কাজ করে। আজিজ খান সিঙ্গাপুরের ৪১তম ধনী। আগের বছর (২০২৩) সে দেশের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় ৪২ নম্বরে ছিলেন। এক ধাপ এগিয়েছেন তিনি।
ফোর্বসের সর্বশেষ তালিকায় ২৩৩ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ নিয়ে প্রথম স্থানে রয়েছেন ফ্রান্সের ধনকুবের বার্নার্ড আর্নল্ট। ১৯৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ইলন মাস্ক এবং ১৯৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন জেফ বেজোস। এ ছাড়া ফেসবুকের মালিক মার্ক জাকারবার্গ ১৭৭ বিলিয়ন ডলার নিয়ে রয়েছেন চতুর্থ অবস্থানে। ফোর্বসের তালিকায় দীর্ঘ সময় প্রথম অবস্থান ধরে রাখা বিল গেটস এবারের তালিকায় আছেন সপ্তম অবস্থানে। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ১২৮ বিলিয়ন ডলার। ওয়ারেন বাফেট ১৩৩ বিলিয়ন ডলার নিয়ে আছেন ষষ্ঠ অবস্থানে। তালিকায় প্রথম দশের মধ্যে রয়েছেন ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানি। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ১১৬ বিলিয়ন ডলার। ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির অবস্থান ১৭তম, যার মোট সম্পদের পরিমাণ ৮৪ বিলিয়ন ডলার। তালিকায় সবচেয়ে বেশি বিলিয়নিয়ার রয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। দেশটির মোট ৮১৩ জন বিলিয়নিয়ারের নাম রয়েছে তালিকায়।
ফোর্বস জানায়, শীর্ষ ধনীর তালিকায় মার্কিনিদের পর সবচেয়ে বেশি আছেন চীনারা, হংকংসহ চীনের মূল ভূখণ্ডের ধনীদের মধ্যে বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ৪৭৩ জন। বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যার ভিত্তিতে দেশ হিসেবে তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছে ভারত। দেশটির ধনীদের জন্য এটি নতুন রেকর্ড। শীর্ষ এই বিলিয়নিয়ারদের তালিকা তৈরিতে ফোর্বস চলতি বছরের ৮ মার্চ থেকে স্টক মূল্য ও মুদ্রার বিনিময় মূল্য ব্যবহার করছে। প্রতি মুহূর্তে বিলিয়নিয়ারদের সম্পদের উত্থান-পতন হিসাব করে ফোর্বসের এই তালিকায় ধনীদের অবস্থান পরিবর্তন হয়ে থাকে।
অর্থ পাচারসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে ২০১৬ সালে পানামা পেপারসে সামিট গ্রুপের আজিজ খানের নাম শীর্ষে উঠে আসে। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করলেও সরকারি পর্যায়ে প্রভাব এবং আইনি জটিলতায় আজও অনুসন্ধান শেষ করতে পারেনি।
বাংলাদেশে সামিট গ্রুপের দুর্নীতি
আজিজ খান বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতসহ বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে অর্জিত প্রায় সব টাকা পাচার করেছেন সিঙ্গাপুরে। সম্প্রতি এমনই একটি তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) দপ্তর থেকে। মাত্র দুই মাস আগেই বিটিআরসি থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল সামিট কমিউনিকেশনস কোনো ফি ছাড়াই তার শেয়ার হস্তান্তর করতে পারবে। তবে আকস্মিকভাবেই সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সংস্থাটি। অভিযোগ উঠেছে, সামিট কমিউনিকেশন নতুন শেয়ার ইস্যুর আড়ালে শেয়ার হস্তান্তর ও বিক্রি করছিল।
সামিট কমিউনিকেশন ২০০৯ সালে আত্মপ্রকাশের পর টেলিকম ও ইন্টারনেট সেক্টরের বৃহত্তম কোম্পানিতে পরিণত হয়। প্রতিষ্ঠানটি মার্চের শেষের দিকে আবুধাবি ও মরিশাসভিত্তিক দুটি পৃথক কোম্পানির কাছে ১৭০ কোটি ৫ লাখ টাকা মূল্যের নতুন শেয়ার ইস্যু করার জন্য বিটিআরসির অনুমোদন চায়। আবেদন অনুসারে প্রতিটি ১২ টাকা দরে মোট ১৪ দশমিক ২০ কোটি নতুন শেয়ার ইস্যু করা হবে। এর এক মাস পর এটির প্রাক-অনুমোদনের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পরের মাসেই সরকারি অনুমোদন আসে। এরপর চলতি বছরের ১২ জুন বিটিআরসি কোম্পানিটিকে কোনো চার্জ ছাড়াই শেয়ার ট্রান্সফারের অনুমতি দেয়। সরকারি অনুমোদনের জন্য পাঠানোর আগে বিটিআরসি আইন সংস্থার আইনি মতামত চেয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল- যেহেতু সামিট কেবল মাত্র নতুন শেয়ার ইস্যু করছে, তাই মোট শেয়ার বিক্রিয় মূল্যের ওপর ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ফি প্রদানের যে নিয়ম রয়েছে তা সামিট কমিউনিকেশনের জন্য প্রযোজ্য হবে না। এ ক্ষেত্রে সামিটও একই কথা উল্লেখ করে ‘এই ফি প্রযোজ্য নয়, কারণ কোম্পানিটি নতুন শেয়ার ইস্যু করে তার মূলধন বাড়াচ্ছে।’ তবে বিটিআরসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বিটিআরসির আইনি ও লাইসেন্সিং বিভাগ শুরু থেকেই চার্জগুলো কোম্পানিটির ওপরই চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। কারণ সামিট আসলে নতুন শেয়ার ইস্যু করার আড়ালে শেয়ার হস্তান্তর ও বিক্রি করছিল।
কিন্তু সামিট কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ফরিদ খান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও তৎকালীন বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানের ছোট ভাই। ফরিদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়েরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফলে সামিট বিশেষ সুবিধা পাচ্ছিল বলে অভিযোগও করেন তারা।
সামিট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে শেয়ার বিক্রয় চুক্তিও বিটিআরসিকে জমা দেয়। সেখানে দেখা যায়, আবুধাবিভিত্তিক কোম্পানি গ্লোবাল এনার্জিকে সামিটের যে নতুন শেয়ার দেওয়ার কথা চুক্তি হয়েছে, তার শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে একজন হলেন আদিবা আজিজ খান, যিনি ফরিদের বড় ভাই সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খানের মেয়ে। এ প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন শেয়ারের মধ্যে ১১৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকার ৯ দশমিক ৪৪ কোটি শেয়ার ইস্যু করা হয়েছিল। অন্যদিকে ৪৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা মূল্যের আরও ৪ দশমিক ৪ কোটি শেয়ার মরিশাসভিত্তিক সেকোইয়া ইনফ্রা টেককে দেওয়া হয়েছিল।
এ অবস্থায় গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে বিটিআরসি আইন সংস্থাকে আবার চিঠি দেয় এবং বলে যে তাদের আইনি মতামত শুধুমাত্র উপদেশমূলক এবং বাধ্যতামূলক নয়। এরপর গত ১৫ আগস্ট সামিট কমিউনিকেশনকে তাদের শেয়ার হস্তান্তরের ফি না দেওয়ার সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন হয়েছে জানিয়ে চিঠি পাঠায় বিটিআরসি। চিঠিটি খবরের কাগজের হাতে এসেছে। সামিট কমিউনিকেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, সামিট কমিউনিকেশনস বিটিআরসির দেওয়া ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটিকে ১০ কোটি ২৪ লাখ টাকা জমা দিয়েছে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যশনালের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সামিট কমিউনিকেশনের এই অর্থ নয়ছয় করার চেষ্টা এবং পরে অর্থ প্রদান করা, সামিট গ্রুপের ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ। ফলে এই অর্থ প্রদানকে সামনে রেখে যেন সামিটের ক্ষমতার অপব্যবহারে অন্যদিকে আর্থিক অনিয়ম রয়েছে তা ঢাকা না পড়ে। সঙ্গে এই অর্থ আদায় একটি উদাহরণ যে, সরকার চাইলে তার ক্ষমতার সুষ্ঠু ব্যবহার করে বিগত দীর্ঘ সময়ে হওয়া আর্থিক অনিয়ম থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে।