আতিকের দুর্নীতির নাটের গুরু এপিএস ফরিদ
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামের একান্ত সহকারী সচিব (এপিএস) ফরিদ উদ্দিন। মেয়রের অনিয়ম ও দুর্নীতির পেছনে নাটের গুরু ছিলেন তিনি। তার নির্দেশে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও কর্মসূচির ব্যয় বাড়াতে ভুয়া ভাউচার তৈরি করা হতো। এসব প্রোগ্রামের টাকা কয়েক গুণ বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
একই সঙ্গে করপোরেশন বিটের কিছু সাংবাদিককে সুবিধা দিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। সাবেক মেয়রের এই এপিএসের বিরুদ্ধে রয়েছে এরকম বিস্তর অভিযোগ।
নথি থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বনানী কবরস্থানে যান। তার আগমন উপলক্ষে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন শুধু প্যান্ডেল, গেট, লাইট বাবদ খরচ দেখিয়েছে ৪৯ লাখ ১১ হাজার ৬৮০ টাকা। ওই বছর ২২ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান উপলক্ষে খরচ দেখানো হয় ৪০ লাখ ৩০ হাজার ৬৮১ টাকা। একই বছরের ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেল দিবস ও ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বনানী কবরস্থানে যান শেখ হাসিনা। এই প্রোগ্রাম দুটির খরচ দেখানো হয়েছে ৯ লাখ ৯৬ হাজার করে। ২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর মেট্রোরেল উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এরিয়া ব্র্যান্ডিং সংক্রান্ত কাজ বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪১ লাখ ২১ হাজার ৬০০ টাকা। এ ছাড়া ২০২৩ সালে ৬ ও ৭ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র, কাউন্সিলর, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সপরিবারে মুন্সীগঞ্জে বার্ষিক বনভোজনে যান। ৬ ও ৭ জানুয়ারি দুই দিনের জন্য সিরাজদীখানের ঢালিস আম্বার নিবাস রিসোর্ট ভাড়া নিয়ে সেখানে অবস্থান করেন তারা। যাতায়াতের জন্য নেওয়া হয় বিশেষ এসি বাস। সন্ধ্যায় আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই আয়োজনে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়নি কোনো ফি। ওই বনভোজনের মধ্যেই প্রথা ভেঙে প্রথমবার ঢাকার বাইরে অনুষ্ঠিত হয় ডিএনসিসির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী বোর্ড সভা। বনভোজন ও বোর্ড সভার জন্য ৬৪ লাখ ৮১ হাজার ২৬৫ টাকা খরচ করা হয় সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকে। শুধু এই বনভোজনে নয়, জাতীয় শোক দিবস, শেখ রাসেল দিবস, জেলহত্যা দিবস, মেট্রোরেল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যয়ের পুরোটাই দেখানো হয়েছে সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন খাত থেকে। সংস্থাটি এসব খাতে সর্বমোট ব্যয় দেখিয়েছে ২ কোটি ৬৪ লাখ ৩৯ হাজার ২২৬ টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের একান্ত সহকারী সচিব (এপিএস) ফরিদ উদ্দিন করপোরেশনের বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও কর্মসূচির ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করতেন। ২০২২ সালের শোক দিবসের খরচ প্যান্ডেল, গেট, লাইট বাবদ খরচে ৪৯ লাখ ১১ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। জেলহত্যা দিবসে প্যান্ডেল, গেট, লাইট বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৯ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। এই দুই অনুষ্ঠানের খরচের বিষয় একই হলেও টাকার অঙ্ক ভিন্ন। জানা গেছে, জেলহত্যা দিবসের সময় এপিএস ফরিদ দেশের বাইরে ছিলেন। সেজন্য মূল খরচটা এখানে এসেছে। কিন্তু তিনি দেশে থাকায় শোক দিবস, বনভোজন, মেট্রোরেল উদ্বোধন অনুষ্ঠানে খরচের পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়েছে। এসব অনুষ্ঠানে ভুয়া বাউচার বানিয়ে প্রোগ্রামের টাকার অঙ্ক বৃদ্ধি করেছেন। এসব প্রোগ্রাম থেকে ভুয়া বাউচারে হাতিয়েছেন বড় অঙ্কের টাকা। শুধু এসব অনুষ্ঠানে নয়, ২০২১ সালে ২৩ অক্টোবর ঠিকানা রিসোর্টে উন্নয়নমূলক কর্মকা ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কিত সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। ওই সভায় খরচ হয়েছে ৭-৮ লাখ টাকা। কিন্তু আতিকের এপিএস ফরিদ উদ্দিনসহ একটি সিন্ডিকেট চক্র ২৯ লাখ টাকা বিল দেখিয়েছে। এর বাইরে প্রতি বছর নানা প্রোগ্রাম ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে সংস্থাটি। যার প্রতিটি সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে ব্যয় দেখানো হতো। এই বিভাগের প্রধানকে চাপ প্রয়োগ করে ভুয়া ভাউচারে সই করে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন ফরিদ।
এ ছাড়া সিটি করপোরেশনে প্রতি বছর যে উন্নয়ন বাজেট হয়, তার ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে নির্দিষ্ট হারে মেয়র আতিক কমিশন নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচি ও অনুষ্ঠানের কেনাকাটা করত করপোরেশন। এ কেনাকাটার জন্যও তিনি নির্দিষ্ট হারে কমিশন নিতেন। যদিও কমিশনের টাকা মেয়র নিজ হাতে না নিয়ে আবু মাহমুদ খান ওরফে পাতলা খানকে দিয়ে নিতেন বলে করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন, মেয়রের ক্যাশিয়ার ছিলেন পাতলা খান। যত কমিশন ও দুর্নীতির টাকা সবই নিতেন তিনি। ফরিদ উদ্দিনের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘বিডি ক্লিন’। এই প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে খাল পরিস্কারসহ বিভিন্ন নামকাওয়াস্তে কাজের মাধ্যমে কয়েক কিস্তিতে সিটি করপোরেশন থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকরা যারা নিয়মিত মেয়র আতিকের অনুষ্ঠান কাভার করে তাদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট বলয় তৈরি করেছেন এই ফরিদ। এসব সাংবাদিকদের অনৈতিক সুবিধা দিয়েছেন মেয়র ও তার এপিএস ফরিদ। এই সিন্ডিকেট সাংবাদিকদের বিদেশেও ভ্রমণে পাঠিয়েছেন। এসব টাকা করপোরেশনের ফান্ড ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে নেওয়া হয়েছে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে করপোরেশন। আর উন্নয়ন বঞ্চিত হয়েছে মানুষ। সার্বিক বিষয়ে জানতে সাবেক মেয়রের এপিএস ফরিদের মুঠোফোনে কল দিলে বন্ধ পাওয়া যায়।