বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে ৭০ ডলার, বাংলাদেশে কেন কমছে না
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে। ব্যারেলপ্রতি এখন তা ৭০ ডলারে নেমে এসেছে। এই প্রবণতা চলতি বছর অব্যাহত থাকবে বলেও বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। কিন্তু দেশের বাজারে তার খুব একটা প্রভাব পড়ছে না। বাস্তবতা হলো, মূল্যস্ফীতির মূল কারণ হিসেবে জ্বালানির উচ্চ দামকেই দায়ী করেন বিশ্লেষকেরা।
একসময় সরকারের নির্বাহী আদেশে তেলের দাম বাড়ত-কমত। কখন বা কবে তা নির্ধারণ করা হবে, তার ঠিকঠিকানা ছিল না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের বিপরীতে যেসব শর্ত দেয়, সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে ফর্মুলাভিত্তিক মূল্য সমন্বয়প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। গত মার্চ মাস থেকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ শুরু করেছে সরকার। এখন প্রতি মাসে নতুন দাম ঘোষণা করা হচ্ছে। তারপরও বিশ্ববাজারে তেলের দাম হ্রাসের খুব একটা প্রভাব পড়ছে না।
সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট সরকার জ্বালানির দাম ঘোষণা করে। সেপ্টেম্বর মাসের জন্য প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কমেছে ১ টাকা ২৫ পয়সা। পেট্রল ও অকটেনের দাম কমেছে ৬ টাকা।
বিশ্ববাজারে দাম অনেকটা কমলেও দেশের বাজারে তার অতটা প্রভাব না পড়ার মূল কারণ হিসেবে ডলারের বিনিময় হারকে চিহ্নিত করা যায়। ধরা যাক, ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্ববাজারে তেলের গড় দাম ছিল ৮০ ডলার এবং এখনো ৮০ ডলার—খালি চোখে বিষয় দুটি একই রকম মনে হলেও বাস্তবে তা নয়।
এই সময় টাকার অনেকটা দরপতন হয়েছে। তখন ডলারের বিনিময়হার ছিল ৮৬ টাকা, এখন যা ১২০ টাকায় উঠেছে। অর্থাৎ এই আড়াই বছরে দেশে ডলারের বিনিময়হার বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এই বাস্তবতায় বিশ্ববাজারে দাম হ্রাসের প্রভাব দেশের বাজারে অনুভূত হওয়া কঠিন বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
জানা যায়, দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের দাম ও ডলারের বিপরীতে টাকার মান হিসাব করা হয়। আগের মাসের জ্বালানি তেলের গড় দামের ভিত্তিতে এখন প্রতি মাসে দাম নির্ধারিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে আছে ৩২ শতাংশ শুল্ক–কর; এটিও বড় বিষয়। সেই সঙ্গে আছে পরিবহনভাড়া; ৬ শতাংশ মুনাফা ধরে বিপিসি।
বর্তমানে আমদানি করা জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে ট্যারিফ মূল্য ধরে শুল্ক হিসাব করা হয়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বা কমলেও এটি পরিবর্তিত হয় না। ট্যারিফ মূল্য সাধারণত কেনা দামের চেয়ে কম ধরা হয়। এতে শুল্ক খরচ কমে বিপিসির। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কেনা দামে শুল্ক নির্ধারণ করতে চায়। সেটা হলে জ্বালানি তেলে বিপিসির খরচ আরও বেড়ে যাবে। যদিও এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তাই ট্যারিফ মূল্য ধরেই দাম নির্ধারণের সূত্র তৈরি করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বা বিপিসি।
কেবল বাংলাদেশই নয়, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও বিপদে পড়েছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালে মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠার রেকর্ড করে। তারা নীতি সুদহার বাড়িয়ে ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ তা পারছে না।
এ ছাড়া সরকার মূলত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কেনে। সরবরাহকারীও নির্দিষ্ট থাকে। যেদিন চুক্তি হয়, তার আগের দিন দিনের গড় দামের ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারিত হয়। তার সঙ্গে তেল পরিবহনের জন্য প্রিমিয়াম যুক্ত হয়। তেলের দাম ওঠানামা করে। ফলে যখন দাম কমে যাচ্ছে, তখন এই চুক্তি করা হচ্ছে কি না, তার ওপর দাম নির্ভর করে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ মূলত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে তেল কেনে। এই দুই দেশ থেকে মারাবান ক্রুড ও অ্যারাবিয়ান লাইট কেনা হয়। এই দুটি তেলের দাম ডব্লিউটিআই ও ব্রেন্ট ক্রুডের চেয়ে কিছুটা বেশি।
আরেকটি বিষয় হলো, দেশের তেল পরিশোধনাগারের সক্ষমতা। বাংলাদেশের তেল পরিশোধনের সক্ষমতা মাত্র ১৫ লাখ টন, যদিও চাহিদা অনেক বেশি। আমদানিই করতে হয় বছরে গড়ে ৬০ লাখ টনের মতো। সক্ষমতা কম হওয়ায় বাংলাদেশকে পরিশোধিত তেল বা ডিজেল কিনতে হয়; এর দাম বিশ্ববাজারে স্বাভাবিকভাবেই অপরিশোধিত তেলের চেয়ে বেশি।
অর্থনৈতিক সুফল পেতে হলে তেলের দাম কমানো দরকার বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। এককভাবে শুধু বিপিসির মাধ্যমে আমদানি না করে অন্যান্য সংস্থাকে দিয়েও আমদানি করানো যায়। এতে বাজারে কিছুটা প্রতিযোগিতা আসবে। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান যদি ভিন্ন উৎস থেকে তেল আমদানি করতে পারে, তাহলে ভোক্তাদেরই লাভ। এ ছাড়া তেলের শুল্ক যৌক্তিকীকরণ করা দরকার।
২০২১ সালের নভেম্বরে দীর্ঘদিন পর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের অন্যতম মানদণ্ড ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮৪ মার্কিন ডলার।
এর মাস তিনেক পর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে প্রতি ব্যারেল ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এমন অবস্থায় সরকার ২০২২ সালে আগস্ট মাসে পণ্যটির দাম সাড়ে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়ায়। তখন বৈশ্বিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ছিল ৯৪ ডলার। এখন সেই দাম ৭০ ডলারে নেমে এলেও দেশের বাজারে তার প্রভাব পড়ছে না।
সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বিপিসির নিট (কর দেওয়ার পর) মুনাফা হয়েছে ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। একই সময়ে সরকারকে লভ্যাংশ দিয়েছে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিপিসির ব্যাংক হিসাবে জমা থাকা উদ্বৃত্ত তহবিল থেকে দুই দফায় ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। এর বাইরে জ্বালানি তেলের শুল্ক–কর থেকে প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায় সরকার। ওই সময় বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম থাকায় সংস্থাটি এত মুনাফা করতে পেরেছিল। টানা সাত বছর মুনাফা করার পর ২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিসি লোকসান করে।
বিপিসির হিসাব বলছে, ওই সময়ে ২ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা লোকসান করে সংস্থাটি। ওই অর্থবছর শেষ হওয়ার এক মাস পর বাড়ানো হয়েছিল জ্বালানি তেলের দাম। এরপর আবার মুনাফার ধারায় ফেরে বিপিসি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিপিসি মুনাফা করেছে ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা; এর মধ্যে সরকারকে লভ্যাংশ দিয়েছে ২০০ কোটি টাকা।
বিষয়টি হলো, জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে অনেক কিছুর সম্পর্ক আছে। সে জন্য তেলের দাম বাড়লে পরিবহনব্যয় এবং শিল্প, কৃষি ও বিদ্যুৎ—সবকিছুর উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। কেবল বাংলাদেশই নয়, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও বিপদে পড়েছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালে মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠার রেকর্ড করে। তারা নীতি সুদহার বাড়িয়ে ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ তা পারছে না।