সরকার পতনের ৪ দিন আগে বসুন্ধরা গ্রুপকে বিশেষ সুবিধা
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের চার দিন আগে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপকে দুই বছর ঋণ পরিশোধ না করার সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকে থাকা ঋণের জন্য গ্রুপটি এই সুবিধা পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ন্যাশনাল ব্যাংকে বসুন্ধরা গ্রুপের ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা, যার মধ্যে সরাসরি ঋণ ৩ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। ব্যাংকটি থেকে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে দেওয়া সরাসরি ঋণ আইন অনুযায়ী তাদের জন্য প্রযোজ্য ঋণসীমার ৮ গুণ বেশি। বসুন্ধরার খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের সময় বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়, যা ছিল তাদের খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের দ্বিতীয় ঘটনা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের পীড়াপীড়িতে গত ৩১ জুলাই এ-সংক্রান্ত চিঠি ন্যাশনাল ব্যাংকের কাছে পাঠানো হয় বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এর আগে ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রস্তাবে অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়।
বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকে থাকা ঋণের জন্য গ্রুপটি এই সুবিধা পেয়েছে। ৩১ আগস্ট শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকে বসুন্ধরা গ্রুপের সরাসরি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা।
ন্যাশনাল ব্যাংকে পাঠানো ওই চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়ে দেয়, ‘এ অনুমোদন ব্যাংকের অন্য কোনো গ্রাহকের বা অন্য কোনো ব্যাংকের অন্য কোনো গ্রাহকের ঋণ হিসাব পুনঃ তফসিলের ক্ষেত্রে নজির হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।’ ফলে বসুন্ধরা গ্রুপের জন্য দেওয়া এই সুবিধাকে বিরল হিসেবে বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বসুন্ধরা গ্রুপের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা মন্তব্য করতে রাজি হননি।
দীর্ঘদিন ধরেই নানা রকম সংকটে রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, ঋণ আদায় করতে না পারায় ব্যাংকের তারল্যসংকট চরম আকার ধারণ করেছে। স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম অনেকটা থমকে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকায় চেক নিষ্পত্তিও বন্ধ রয়েছে। অনেক শাখা ব্যবস্থাপক কার্যালয়ে অনুপস্থিত থাকছেন। গত জুন শেষে ব্যাংকটির ঋণ ছিল ৪২ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ২০ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪৯ শতাংশ।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০ আগস্ট ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এত দিন ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ ছিল এস আলম গ্রুপের হাতে। নতুন পরিচালনা পর্ষদে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। এরপর ব্যাংকটি বসুন্ধরাকে দেওয়া আগের সুবিধা পরিবর্তন করে বলে জানা গেছে।
কত ঋণ
একটি ব্যাংক থেকে একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কী পরিমাণ ঋণ ও ঋণসুবিধা নিতে পারবে, তা ব্যাংক কোম্পানি আইনে নির্দিষ্ট করা আছে। এতে বলা হয়েছে, একটি গ্রুপকে কোনো ব্যাংক সরাসরি ঋণ হিসেবে তার পরিশোধিত মূলধনের ১৫ শতাংশ এবং ঋণসুবিধা অর্থাৎ ঋণপত্র, গ্যারান্টি ইত্যাদি হিসেবে ১০ শতাংশ অর্থ দিতে পারবে। সেই হিসাবে ন্যাশনাল ব্যাংক বসুন্ধরা গ্রুপকে ৪৮২ কোটি টাকা সরাসরি ঋণ ও ৩২১ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দিতে পারে।
ন্যাশনাল ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ৩১ আগস্ট শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকে বসুন্ধরা গ্রুপের সরাসরি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। এই সময়ে ঋণসুবিধার পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫ কোটি টাকার (নন–ফান্ডেড)। সব মিলিয়ে গ্রুপটিকে সীমার প্রায় ৮ গুণ বেশি ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। আইন ভেঙে বসুন্ধরাকে এই বিপুল পরিমাণ ঋণ দিতে বিভিন্ন সময়ে বিশেষ অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। এখন এসব ঋণের কারণে ব্যাংকটি সংকটে পড়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের ৩১ আগস্টের তথ্য অনুযায়ী, বসুন্ধরা পেপার মিলস ও বসুন্ধরা মাল্টি পেপারের ঋণ ৮১০ কোটি টাকা। মেঘনা সিমেন্ট মিলস, বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স ও বসুন্ধরা ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ঋণ ১৮০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ঋণ ১৯০ কোটি টাকা, বসুন্ধরা মাল্টি ফুডের ৯৬৪ কোটি টাকা, বসুন্ধরা মাল্টি ট্রেডিংয়ের ১৫৬ কোটি টাকা ও বসুন্ধরা এয়ার ওয়েসের ঋণ ৩৪ কোটি টাকা। পাশাপাশি বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানির ঋণ ৬৭৯ কোটি টাকা এবং বসুন্ধরা ইমপোর্ট এক্সপোর্ট কোম্পানির ঋণ ছিল ৮৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বসুন্ধরা মাল্টি ফুডের ঋণ সুবিধা ১৪ কোটি টাকা। তথ্যানুযায়ী, এর মধ্যে ৭টি প্রতিষ্ঠানের ২৮টি কিস্তি বকেয়া রয়েছে।
যেভাবে সুবিধা দেওয়া হলো
চলতি বছরের শুরুতে বসুন্ধরা গ্রুপের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে। গত এপ্রিলে ঋণ পুনঃ তফসিলের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংকে আবেদন করে তারা। আবেদনে গ্রুপটি সাত বছরের জন্য দ্বিতীয়বার ঋণের পুনঃ তফসিল এবং দুই বছর ঋণ ও কিস্তি পরিশোধে বিরতি চায়। ২০২২ সালে খেলাপি ঋণ পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে নীতিমালা করেছিল, তার আলোকে এই সুবিধা চায় গ্রুপটি। করোনাভাইরাস মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য এই নীতিমালা করা হয়েছিল। ওই নীতিমালায় বলা হয়, এর আওতায় সুবিধা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে সর্বোচ্চ এক বছর ঋণ পরিশোধে বিরতি দেওয়া যাবে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ জুনে বসুন্ধরার আবেদন অনুমোদন করে। কিন্তু নীতিমালায় দুই বছর ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়ার সুযোগ না থাকায় ৩০ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন চায় ন্যাশনাল ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ঋণ পুনঃ তফসিলের অনুমতি দেবে না, এমন নীতি নিয়েছিল। ফলে ন্যাশনাল ব্যাংকের আবেদনটি চাপা পড়ে যায়। সূত্র জানায়, জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সেই নীতি থেকে সরে এসে বসুন্ধরা গ্রুপের ঋণ পুনঃ তফসিলে অনুমতি দেন।
৩১ জুলাই ন্যাশনাল ব্যাংকে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়, বসুন্ধরা গ্রুপের ঋণ পুনঃ তফসিলের ক্ষেত্রে ২০২২ সালের নীতিমালার সর্বোচ্চ এক বছরের ঋণ পরিশোধে ছাড়ের শর্ত ছাড়া অন্য শর্তগুলো পালন করতে হবে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নিজ বিবেচনায় দুই বছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধে ছাড়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই চিঠির ভিত্তিতে গ্রুপটিকে ঋণ পরিশোধে ছাড়ের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় ন্যাশনাল ব্যাংক।
আমরা নতুন আমানত পণ্য এনে তারল্যসংকট কাটানোর চেষ্টা করছি। পাশাপাশি ঋণ আদায় জোরদার করা হয়েছে। অন্যান্য ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তার জন্যও চেষ্টা করা হচ্ছে
ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তৌহিদুল আলম খান
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০ আগস্ট ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এত দিন ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ ছিল এস আলম গ্রুপের হাতে। নতুন পরিচালনা পর্ষদে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। এরপর ব্যাংকটি বসুন্ধরাকে দেওয়া আগের সুবিধা পরিবর্তন করে বলে জানা গেছে।
বসুন্ধরা গ্রুপকে দেওয়া সুবিধা সম্পর্কে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তৌহিদুল আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রুপটি ঋণ পুনঃ তফসিলের আবেদনে দুই বছর ঋণ পরিশোধে বিরতি চেয়েছিল। আমাদের পরিচালনা পর্ষদে সেভাবে অনুমোদন হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাতে সম্মতি দিয়েছিল। এখন তারল্যসংকটে পড়ার কারণে তা এক বছর করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি শর্ত দেওয়া হয়েছে ঋণের সুদ প্রতি মাসে পরিশোধ করতে হবে।’
তারল্যসংকট থেকে উত্তরণে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, জানতে চাইলে তৌহিদুল আলম খান বলেন, ‘আমরা নতুন আমানত পণ্য এনে তারল্যসংকট কাটানোর চেষ্টা করছি। পাশাপাশি ঋণ আদায় জোরদার করা হয়েছে। অন্যান্য ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তার জন্যও চেষ্টা করা হচ্ছে।’