‘স্ত্রী বলছে যৌতুকের জন্য লাথি-ঘুষি মেরেছি, কিন্তু নয় মাস ধরে সে বাপের বাড়ি’
পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার
প্রশ্ন: আমার স্ত্রী গত ৯ মাস আমার সঙ্গে নেই। কিন্তু ৫ মাস আগে সে আমাকে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১১(গ) ধারায় মামলা দিয়েছে। মামলার বিবরণীতে উল্লেখ করেছে, আমি ৩ লাখ টাকা যৌতুকের জন্য তাকে ঘুষি-লাথি মেরেছি এবং সে তাতে অজ্ঞান হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেলে এক দিন সে ভর্তি ছিল এই মারফতে এমসি সংগ্রহ করে। কিন্তু তার মামলার বিবরণীর সঙ্গে মেডিকেল সার্টিফিকেটের (এমসি) মিল নেই। এমসিতে এসেছে তার বাঁ পায়ে মুঠোফোনের চার্জার দিয়ে আঘাতের দুটো দাগ।
অথচ ঘটনার সময় সে আমার বাসাতেই ছিল না। চলতি মাসের শুরুতে আমি এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ২১ দিন পর জামিনে বের হই। শুনানিতে সে আমার ঘর করবে না বলে জানিয়েছে। তখন আদালত আমার কাবিনের টাকার অর্ধেক ৬ লাখ টাকা পরবর্তী তারিখে নিয়ে আদালতে উপস্থিত হতে বলেন। এখন এই মুহূর্তে আমার পক্ষে ১ লাখ টাকার মতো ব্যবস্থা করা সম্ভব। ৬ লাখ টাকা কোনোভাবেই পরবর্তী তারিখে দেওয়া সম্ভব না। এ ক্ষেত্রে আমার করণীয়?
উত্তর: আপনার স্ত্রী আপনার নামে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ১১(গ)ধারায় মামলা দিয়েছেন। আপনি জানিয়েছেন, ঘটনার সময় তিনি আপনার বাড়িতে ছিলেন না। তা ছাড়া তাঁর মামলার বিবরণীর সঙ্গে মেডিকেল সার্টিফিকেটের কোনো মিল নেই।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ১৭(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করান, তাহলে মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তি অনধিক সাত বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। কেউ যদি কাউকে হয়রানি করতে বা চাপ প্রয়োগ করতে মামলা করেন বা মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে থাকেন, তাহলে তা ফৌজদারি অপরাধ। এর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে।’ মিথ্যা অভিযোগকারী কিংবা মিথ্যা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে ম্যাজিস্ট্রেট যদি মনে করেন, আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো মিথ্যা বা হয়রানিমূলক এবং আসামির প্রতি কোনো ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে মামলাটি করা হয়েছে, তাহলে এই ধরনের মামলা মিথ্যা মামলা হিসেবে গণ্য হবে। মামলা মিথ্যা বা ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হলে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগকারী বা মামলা দায়েরকারীকে দণ্ড দিতে পারেন। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বাদী হয়ে পৃথক মামলা দায়ের করতে পারেন।
মিথ্যা মামলা প্রমাণিত হলে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশও দিতে পারেন। এমনকি আদালত মিথ্যা অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে দণ্ডমূলক ব্যবস্থাও নিতে পারেন।
দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় বলা আছে, মিথ্যা মামলার সাজা হলো দুই বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম ও বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় ধরনের দণ্ড। যদি মিথ্যা মামলা কোনো মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা সাত বছর বা তার বেশি মেয়াদের কোনো দণ্ডনীয় অপরাধ সম্পর্কে দায়ের করা হয়, তাহলে মিথ্যা মামলা দায়েরকারী বা বাদী সাত বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এর সঙ্গে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীকে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
এবার দেনমোহর প্রসঙ্গে আসি। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫-র ০৫ ধারা অনুসারে বাংলাদেশের যেকোনো মুসলিম নারী তাঁর দেনমোহর দাবি করে সহকারী জজ আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন। কিন্তু আপনার স্ত্রী পারিবারিক আদালতে দেনমোহর আদায়ের মামলা করেছেন কি না, তা আপনার প্রশ্নে স্পষ্ট নয়। দেনমোহর–সংক্রান্ত আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার আছে পারিবারিক আদালতের। পারিবারিক আদালতে দেনমোহর–সংক্রান্ত কোনো আদেশ হলে ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালত ডিক্রিকৃত টাকা দায়িকের (যিনি পরিশোধ করবেন) দরখাস্তের ভিত্তিতে ন্যায়সংগত কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দিতে পারেন, যা ৫২ ডিএলআরের ১৫৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে।
যদি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে আপনাকে দেনমোহর পরিশোধের আদেশ দিয়ে থাকেন (সম্ভবত মৌখিক), সেখানে আপনি কারণ দেখিয়ে সময় প্রার্থনা করতে পারেন। তবে যদি কোনো লিখিত আদেশ দেন, সে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারেন। তবে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতেই হবে।