বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|Sunday, December 22, 2024
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » জাতীয় » ছাত্রলীগ নিষিদ্ধে যেসব কারণ উল্লেখ করেছে সরকার

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধে যেসব কারণ উল্লেখ করেছে সরকার 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবির মুখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এখন ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলো।

বুধবার রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছিল।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে বিগত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ-যৌন নিপীড়নসহ নানা জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। এ সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনন্দ মিছিল করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা–কর্মীরা। বুধবার রাতে
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনন্দ মিছিল করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা–কর্মীরা। বুধবার রাতেছবি: প্রথম আলো

সরকারের প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, গত ১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে উন্মত্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করে শত শত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিকে হত্যা করেছে এবং আরও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। এসব কারণ উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকার ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’-এর ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল এবং এই আইনের তফসিল-২-এ এই ছাত্রসংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করল।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করা কমিটির গত মাসের এক হিসাবে দেখা যায়, জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে তখন পর্যন্ত প্রায় ৮০০ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনন্দ মিছিল করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা–কর্মীরা। বুধবার রাতে
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনন্দ মিছিল করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা–কর্মীরা। বুধবার রাতেছবি: প্রথম আলো

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাঙালির স্বাধিকারের বিভিন্ন আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রলীগ। তবে সময়ের পরিক্রমায় ছাত্রলীগ একাধিক ধারায় বিভক্ত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিজেদের মধ্যে দলাদলি, অন্তঃকোন্দল, হামলা-মারামারি, খুন, শিক্ষার্থী নির্যাতন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে ছাত্রলীগের সমালোচনা হয়েছে।

চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০১৯ সালে সমালোচনার মুখে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী (শোভন) ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করেন শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন আবরার। পরে ওই হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড আর ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন আদালত।

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় দরজি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিৎ দাসকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন মৃত্যুদণ্ড এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান। একই বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদকে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলন শুরু হলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। একই দাবিতে ২০২৪ সালে আবার আন্দোলন শুরু হলে গত ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ওই দিনই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ক্যাম্পাসে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ হয়েছে, তার জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত। তবে ১৬ জুলাই রাতে এবং পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বের করে দেন শিক্ষার্থীরা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তাঁদের বের করে দেওয়া হয়।

২০২২ সাল থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন সাদ্দাম হোসেন। সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ (ইনান)। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে আত্মগোপনে চলে যান ছাত্রলীগের নেতারা। তবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পর রাতে ছাত্রলীগের প্যাডে তাঁদের স্বাক্ষরে একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। বিবৃতিতে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করা হয়।

যে দাবির মুখে নিষিদ্ধ হলো

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে আসছিল। গত মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাদের ঘোষিত পাঁচ দফা দাবির দ্বিতীয়টি ছিল ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে এই সপ্তাহের মধ্যে আজীবন নিষিদ্ধ করতে হবে। এরই মধ্যে বুধবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সেখান থেকে ছাত্রলীগকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে নিষিদ্ধ করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়।

এই সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন বাংলাদেশে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। গত ১৬ বছর ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগ যে ধরনের নৃশংসতা চালিয়েছে ও হলগুলোকে যেভাবে নির্যাতনকেন্দ্র বানিয়েছে, সেখানে তাদের ন্যূনতম পুনর্বাসনের সুযোগ নেই। একটি জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য যত ধরনের উপাদান প্রয়োজন, সব কটিই ছাত্রলীগের রয়েছে।

আনন্দমিছিল

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় আনন্দমিছিল ও সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বুধবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যে এসে সমাবেশ করে।

এর আগে তাদের পক্ষ থেকে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের কথা ছিল। এ জন্য রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে তারা উপাচার্যের বাসভবনের সামনের চত্বরে জড়ো হতে থাকে। পরে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে তারা আনন্দমিছিল করে।

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone