ফেঁসে যাচ্ছেন অনেক রাঘববোয়াল
শেয়ার কারসাজি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স অবস্থান নিয়ে কঠোর পদক্ষেপে যাচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এবার ফেঁসে যাচ্ছেন শেয়ার কারসাজিতে জড়িত রাঘববোয়ালরা। হাসিনা সরকারের গত ১৫ বছরে কারসাজি সিন্ডিকেটের দাপটে পর্যুদস্ত ছিল শেয়ারবাজার। সে সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঢিলেঢালা নজরদারি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অভাবে অনেক বিনিয়োগকারী তাঁদের টাকা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এবার সেই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বিএসইসি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগস্টের আগে শেয়ারবাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এতে তৈরি হয় আস্থার সংকট। বড় বড় অনিয়ম করে শত শত কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিলেও বিএসইসি জরিমানা করেছে নামমাত্র। কয়েকটি শেয়ারের মূল্য কারসাজি করায় ২০২২ সালে বিএসইসি মাত্র ২১ কোটি টাকা জরিমানা করেছিল। যেখানে শেয়ার জালিয়াতকারীরা ২৫৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। ২০২৩ সালে শেয়ারের দাম কারচুপির দায়ে ২ কোটি টাকা জরিমানা করা হলেও কারচুপিকারীদের মুনাফা হয়েছিল ১৫ কোটি টাকা। গত ১৫ বছরে একই পরিস্থিতি দেখা যায়। ২০২১ সালের আগে দু-একটি প্রতিষ্ঠান শেয়ারের দাম কারসাজিতে জড়িত ছিল প্রমাণ হলেও ২০২২ সালে ১৫টির বেশি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ পাওয়া যায়। ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশনের (ইউএফএস) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মিউচুয়াল ফান্ড থেকে প্রায় ১৮০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তদন্ত চলে চার মাসের বেশি। ততদিন কারসাজিকারীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবার এ সিন্ডিকেট ধরতে জিরো টলারেন্স অবস্থা নিয়েছে বিএসইসি। এর অংশ হিসেবে অতিসম্প্রতি শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৩৪ কোটি টাকার বেশি জরিমান করা হয়েছে সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল খায়েরকে। যিনি শেয়ারবাজারে ‘হিরো’ নামে পরিচিত। শেয়ার কারসাজির মূলহোতা হিরো, তাঁর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, বাবা আবুল কালাম মাতবর, মা আলেয়া বেগম, বোন কণিকা আফরোজ, ভাই মোহাম্মদ বাসার ও সাজিদ মাতবর, স্ত্রী সাদিয়া হাসানের ভাই কাজী ফুয়াদ হাসান ও কাজী ফরিদ হাসান এবং হিরোর প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভ ও মোনার্ক হোল্ডিংকে মোট ১৩৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে গত মাসের দিকে বেক্সিমকো গ্রুপের শেয়ার লেনদেনে কারসাজির ঘটনায় নয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৪২৮ কোটি ৭ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি। দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে কারসাজির বিরুদ্ধে এটি সবচেয়ে বড় জরিমানা। কোম্পানিটির মালিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা বহুল সমালোচিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান। এ ছাড়া মারজানা রহমান ৩০ কোটি, ট্রেড নেক্সট ইন্টারন্যাশনাল ৪ কোটি ১ লাখ, মুশফিকুর রহমান ১২৫ কোটি, মমতাজুর রহমান ৫৮ কোটি, জুপিটার বিজনেস ২২ কোটি ৫০ লাখ, এপোলো ট্রেডিং ১৫ কোটি ১ লাখ, এ আর টি ইন্টারন্যাশনাল ৭০ কোটি, আবদুর রউফ ৩১ কোটি ও ক্রিসেন্টকে ৭৩ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযুক্তরা ২০২১ সালের ২৮ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত সাত মাস ১০ দিনে সংঘবদ্ধভাবে কোম্পানির শেয়ার অস্বাভাবিকভাবে লেনদেন করেন। এদিকে আরও নয়টি কোম্পানি পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। এসব কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে কোন কাজে ব্যবহার করেছে, খতিয়ে দেখা হবে। কোম্পানিগুলো হলো বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, বেস্ট হোল্ডিংস, ইনডেক্স এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, জেএমআই হসপিটাল, লুব রেফ (বাংলাদেশ), নাভানা ফার্মাসিউটিক্যাল, রিং শাইন টেক্সটাইল, সিকদার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এবং সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালস। জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র রেজাউল করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘একটি স্থিতিশীল শেয়ারবাজার গড়ে তুলতে যা করা প্রয়োজন সেভাবে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। এখানে সব ধরনের অস্বাভাবিক লেনদেনের ওপর কঠোর নজরদারি আমাদের রয়েছে। কারও অনিয়ম বা কারসাজির প্রমাণ পেলে বিএসইসি কঠোর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেবে।’ ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘গত ১৫ বছর বিএসইসি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ২০০৯-২০১০ সালে শেয়ারবাজারের পতনের পর লাখ লাখ বিনিয়োগকারী তাঁদের পুঁজি হারিয়ে পথে বসেন। শেয়ার কেনায় মার্জিন ঋণ প্রদানকারী বহু প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায়। এর পর থেকে বাজার পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হওয়ায় বারবার ক্ষতির মুখে পড়ে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী বাজার ছেড়ে চলে যান। এ কারসাজি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এখন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’