রাজধানীতে নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহন
প্রধান প্রতিবেদক : রাজধানীর ডিজিটাল ট্রাফিক ব্যবস্থা এখনো হাতনির্ভর। দিনভর যানজট থাকে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে। ১০ লাখ পরিবহনের দেখভাল করার কেউ নেই! সঙ্কট দক্ষ চালকের। বাদুড়ঝোলা হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলছেন যাত্রীরা। বন্ধ হয়ে গেছে এসি বাস সার্ভিস। নেই বাস কাউন্টার। উঠে গেছে টিকেট পদ্ধতি। সিটিং সার্ভিসের নামে বাড়তি ভাড়া আর প্রতারণার ফাঁদ পথে পথে। লক্কড়-ঝক্কড় বাস রাজধানীজুড়ে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে মেট্রোরেল স্থাপন, পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট আইন’ চূড়ান্ত করা হয়েছে। ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট বা দ্রুত গণপরিবহন আইনের আওতায় বহুল আলোচিত মেট্রোরেল পরিচালিত হবে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে এ আইনের খসড়া ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। আইনে মেট্রোরেলের যাত্রী ও মেট্রোরেলের বীমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গণপরিবহন আইন নাম দেয়া হলেও এ আইনের মাধ্যমেই মেট্রোরেল পরিচালনা করা হবে। রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করলেও পরবর্তীতে ঢাকার আশপাশেও মেট্রোরেল স্থাপন করা হবে। সে কারণেই নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ ও গাজীপুর জেলাকে এ আইনে যুক্ত করা হয়েছে। আইনে উল্লেখ করা হয়েছে, লাইসেন্স ছাড়া দ্রুত গণপরিবহন ব্যবস্থা পরিচালনা করা যাবে না। কেউ এই বিধান লঙ্ঘন করলে তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অনাদায়ে আর্থিক জরিমানা দিতে হবে। ট্রাফিক সাইন, সঙ্কেত, রোড মার্কিং ও গতিসীমাসংক্রান্ত বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা পাচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে ট্রাফিক জ্যামের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। যাত্রীদের ক্ষেত্রে যা ১২ হাজার কোটি, ব্যবসা-শিল্প ও রফতানিবাণিজ্যের ক্ষেত্রে ৪ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া পরিবেশগত ক্ষতি দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা। জ্বালানি, দুর্ঘটনা ও মেডিক্যালসহ বিভিন্ন খাতে বাকি অর্থ অপচয় হয়ে থাকে। মহানগরীতে যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ ঘণ্টা বাণিজ্যিক সময় (বিজনেস আওয়ার) নষ্ট হচ্ছে। সম্প্রতি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) পুরকৌশল বিভাগের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এদিকে গণপরিবহন চলাচলে নেই কোন নিয়ন্ত্রণ। ঢাকায় রেজিস্ট্রেশনকৃত মোট পরিবহনের সংখ্যা সাত লাখ ৮০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে অটোরিক্সা সাত হাজার ৯৪৭টি, অটোটেম্পো এক হাজার ৬৬৪, বাস ২০ হাজার ৪৭৩, কার্গো ভ্যান চার হাজার ৬৬২, কাভার্ড ভ্যান ৯ হাজার ২০৭, ডেলিভারি ভ্যান ১৪ হাজার ১১৫, হিউম্যান হলার তিন হাজার ৫৪৭, জীপ ২৩ হাজার ৫৬৬, মাইক্রোবাস সাড়ে ৫৪ হাজারের বেশি, মিনিবাস প্রায় ১০ হাজার, মোটরসাইকেল প্রায় সাড়ে তিন লাখ, প্রাইভেট প্যাসেঞ্জার কার প্রায় দুই লাখ, ট্যাক্সিক্যাব ৩৬ হাজারের বেশি, ট্রাকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩৭ হাজারসহ রয়েছে অন্যান্য পরিবহন। অনুমোদনহীন মিলিয়ে ঢাকায় পরিবহন চলছে প্রায় ১০ লাখ।
রাজধানীর যানজট নিরসন ও পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে ২০০৯ সালের আট ডিসেম্বর থেকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে লেন পদ্ধতিতে পরিবহন চলাচল শুরু হয়। কিন্তু এ পদ্ধতি বেশি দিন কার্যকর হয়নি। মাত্র চার মাসেই লেন পদ্ধতির বিলুপ্তি ঘটে।
৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা ডিজিটাল ট্রাফিক ব্যবস্থা কার্যত ভেস্তে যেতে বসেছে। চলমান ট্রাফিক সিগন্যাল পদ্ধতি রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি বছর কোটি টাকা ব্যয় হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। হাতনির্ভর নগরীর ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা। ২০০৯ সালের শেষের দিকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল। এ প্রকল্পের মধ্যে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন ছাড়াও পুলিশের গাড়িতে অটোমেটিক ভেহিক্যাল লোকেশন সিস্টেম বসানোসহ ডিজিটাল রেডিও ট্র্যাকিং পদ্ধতিতে দেড় হাজার ওয়াকিটকি সংযোগের কথা ছিল। এ প্রকল্পের কাজ দেয়া হয়েছিল ব্রুনাইভিত্তিক বাংলাদেশের লোকাল এজেন্ট রাফা ট্রেডিং লিমিটেডকে। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ ৩১টি পয়েন্টে স্থাপন করা হয়েছিল ডিজিটাল ডিসপ্লের তার বেশিরভাগই এখন বন্ধ।
২০ দশমিক এক কিলোমিটারব্যাপী মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জাপান সরকারের দাতা সংস্থা জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশের সরকার। ২০২১ সাল নাগাদ মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শেষ হবে। প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প। চলতি বছরের জুনের মধ্যেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ চূড়ান্ত করার কথা আছে। ২০ কিলোমিটারের বেশি এ রেলপথে ১৬টি স্টেশন থাকবে। মেট্রোরেল প্রতি ঘণ্টায় ৮০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। ফলে রাস্তায় যাত্রী এবং পরিবহন উভয়ের ওপরই চাপ কমবে।