পানির জন্য হাহাকার, ওয়াসার দাবী ভিন্ন!
এইদেশ এইসময়, ঢাকা : গরম আসার শুরু থেকেই পানি সংকটে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মানুষর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। অনেক এলাকায় এই তীব্র গরমেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অনেক এলাকায় পানি পাওয়া গেলেও তা দুর্গন্ধময়। তবে বিভিন্ন এলাকায় পানি সংকটে মানুষ দিশেহারা হলেও ওয়াসার দাবি রীতিমতো বিস্ময়কর। তারা বলছে, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি।
ওয়াসার দাবি নারায়ণগঞ্জসহ রাজধানী ঢাকাকে মোট ১১টি অঞ্চলে ভাগ করে পানি সরবরাহ করা হয়। ঢাকা মহানগরীতে দিনে ২২৫ কোটি লিটার পানির চাহিদার বিপরীতে ২৪২ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
বিভিন্ন এলাকায় পানি না পাওয়ার বিষয়ে ওয়াসার ব্যাখ্যা, ‘এটি পকেট সমস্যা’। বৃষ্টি হলে এই সংকট সমাধান হয়ে যাবে।
ঢাকা ওয়াসার সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘গরমে চাহিদা বেড়েছে। চাহিদা বাড়লেও আমাদের পানির সংকট নেই। রাজধানীর পানির ৭৮ ভাগই টিউবওয়েলে উত্তোলন করা হয়। বৃষ্টি না হওয়ার কারণে পানির স্তর অনেক নীচে নেমে গেছে। তাই টিউবওয়েলে পানি উত্তোলন করা যাচ্ছে কম। বৃষ্টি হলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে’।
ওয়াসার দাবি আর বাস্তবতা ভিন্ন:
ওয়াসার দাবি, পানি সরবরাহ ঠিক আছে, কিন্তু ফার্মগেট, মগবাজার, মিরপুর-২, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পানি সংকটে বাসিন্দাদের নাকাল হতে দেখা গেছে।
তারা টাকা দিয়েও ওয়াসার এক গাড়ি পানি সংগ্রহ করতে পারছেন না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তারা ঢাকা ওয়াসার কাছে একাধিকবার অভিযোগ করার পরও সংকট নিরসনে উদ্যোগী হচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।
শাঁখারীনগর লেন, আলমগঞ্জ লেন ও আলমগঞ্জ রোডে গত এক বছর ধরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুই ঘণ্টাও পানি থাকে না বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন। এবার গরম বৃদ্ধির পর গত এক মাস যাবৎ এসব এলাকার কলে পানি একেবারেই আসছে না।
গরম বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীর মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, দক্ষিণ মনিপুর, কাফরুল, কল্যাণপুরেও পানির সমস্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। কোথাও পানি নেই, কোথাও পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ। মিরপুর ২ নম্বর সেকশন সংলগ্ন কাজীপাড়ায় ৩ মাস ধরে পানি সংকট চলছে। মিরপুর ১৪ নম্বর এলাকা সংলগ্ন বৌবাজার এলাকায় পানির কল খুললে ময়লার সঙ্গে কেঁচোও আসছে। মাঝে মাঝে পানি আসছে না।
ইস্কাটন গার্ডেন, গোপীবাগ, পেয়াদাপাড়া, মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির এক নম্বর সড়ক, নবোদয় হাউজিং, উত্তরা ও গুলশানের কিছু অংশে পানির সমস্যার কথা জানিয়েছেন এলাকাবাসী। পেয়াদাপাড়া, ওয়ারী ও বনগ্রাম এলাকায় ওয়াসার পানিতে ঝাঁজালো গ্যাসের দুর্গন্ধ আসছে। এই পানি দিয়ে হাত, মুখ ও গোসল করলে চোখ জ্বালাপোড়া করে। গা থেকে দুর্গন্ধ আসে। ওই এলাকার বাসিন্দারা রামকৃষ্ণ মিশন ও ওয়ারী পাম্প থেকে পানি সংগ্রহ করছেন।
তবে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পানি সংকটের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ সংকটকে দায়ী করেছে। রাজধানী এবং নারায়ণগঞ্জে ৬৭০টি পানি উত্তোলন পাম্প রয়েছে। বিদ্যুৎ্ সংকটের সময় জেনারেটর ব্যবহার করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ জেনারেটর ব্যবহার করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে অনেক জেনারেটর বিকল হয়ে পড়ছে।
সুনির্দিষ্ট এলাকা ধরে জানতে চাইলে ওয়াসার সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল আলম চৌধুরী অবশ্য কিছু সমস্যার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু জায়গায় টিউবওয়েল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এই সমস্যা হচ্ছে। আর একটি নষ্ট টিউবওয়েল মেরামত করতে ১৫ দিন থেকে এক মাসও লেগে যেতে পারে’। পাইপলাইনে পানি না পেলে গাড়িতে করে সরবরাহ করা হয় বলে জানিয়েছেন এই ওয়াসা কর্মকর্তা।
ওয়সার কর্মচারীদের বাণিজ্য:
পানি সংকটকে পুঁজি করে ওয়াসার একশ্রেণীর কর্মচারী মোটা অংকের টাকায় পানি বিক্রি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারিভাবে এক গাড়ি পানির দাম ৫০০ টাকা হলেও পানির লরির চালকরা সেই পানি এক হাজার থেকে এক হাজার দুইশ টাকায় বিক্রি করছে।
৪৪ ইস্কাটন গার্ডেনে বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক আবদুর রহিম জানান, এক গাড়ি পানির জন্য সকাল থেকে কয়েকবার ইস্কাটন গার্ডেন মড্স জোন-৬ পানির পাম্পে ফোন দেয়া হলে তারা ফকিরের পুল ওয়াসা অফিসে ফোন করতে বলে। ওই অফিসে ফোন করা হলে তারা ইস্কাটন মড্স জোনে যোগাযোগ করতে বলে। পরে ইস্কাটন মড্স জোনে ফোন করা হলে তারা জানায় পানি দেওয়া হবে। কিন্তু পানি আর আসেনি।
ফকিরেরপুল অফিসে যোগাযোগ করা হলে খায়রুল হাসান নামে এক কর্মকতা বলেন, ‘তারা (ইস্কাটন মড্স জোন) ফাঁকিবাজি করছে আপনাদের সাথে। ওটা ভিআইপি এলাকার পানির পাম্প তারা চাইলে যে কোন জায়গায় পানি দিতে পারে’।
আবদুর রহিম অভিযোগ করে বলেন, প্রতি গাড়ি পানির মূল্যে ছয়শ টাকা হলেও সাথে অন্তত দুইশ টাকা বখশিস দিতে হয়। বখশিস যদি কম হয় তারা পরে আসতে চায় না।
ভুক্তভোগী মানুষ অভিযোগ করে বলেছেন, টাকা দিয়েও এই এলাকায় পানি মিলছে না। কোনো কোনো এলাকায় প্রতিটি গাড়ির জন্য গুনতে হচ্ছে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত।
জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ করা হলে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। জোন-৩ একটি অভিযোগ এসেছিল আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি।
শুক্রবার দুপুর ১২টা পনের মিনিট রাজধানীর শান্তিবাগ নূর মসজিদের জুমার নামাজের আযান দেওয়া হয়। আযান দেওয়ার পর মসজিদের মাইক থেকে বিশেষ ঘোষণায় বলা হচ্ছে নূর মসজিদের অযুর পানি নাই, তাই মুসল্লিদেরকে বাসা থেকে অযু করে আসার অনুরোধ করা হল। এমন ঘোষণা এই মসজিদ থেকে মাঝে মধ্যেই দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। এবারে গরমের মৌসুমে শুরু হওয়ার পর থেকে এই মসজিদে পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
শাহজাদপুর ঝিলপাড়ের পানির পাম্পে গিয়ে দেখা গেছে, হাতে বড় বালতি, পানির জার, ড্রাম নিয়ে মানুষের লম্বা লাইন। ওই পাম্পে একটি মাত্র পানির কল থাকায় সেখানে ভিড় বেশি লেগেই থাকে ভোর থেকে। পানির জার নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা আমেনা বেগমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাই বাসায় খাওয়ার পানিই আবার গোসলের কথা চিন্তা করবো।
আমেনা বেগম বলেন, মাঝে মধ্যেই বাসার পানির লাইনে পানি পাওয়া যায়। যে পানি আসে, সেটা পান করার মতো নয়। পানি এতই দুর্গন্ধ যে, ফুটালেও তা দূর হয় না। আবার যখন মুখে দিলে মুখ জ্বলে। তাই মাঝে মধ্যে আত্মীয় বাসায় গিয়ে গোসল করে আসি।
তবে অনেকেই এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করে বলেন, একটি পানির কল থাকলেও ওটা থেকে সবাইকে পানি নিতে দেওয়া হয় না। ফুটপাতে পানির ব্যবসা করে এমন লোকজন এটা দখল করে রেখেছে, বাসাবাড়ি থেকে পানি নিতে এলে তাদের জন্য বিরাট লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
এদিকে ওয়াসার অভিযোগ শাখায় প্রতিদিন মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, পীরেরবাগ, কাফরুল, পল্লবী, রূপনগর, পশ্চিম ধানমন্ডি, মধুবাজার, রায়েরবাজার, ট্যানারি মোড়, জুরাইন পাইপ রাস্তা, মিরহাজীরবাগ, দোলাইরপাড়, পোস্তগোলা, গোপীবাগ, শান্তিবাগ, গুলবাগ, শাহজাহানপুর, ইংলিশ রোড, মালিটোলা, জিন্দাবাহার লেন, বংশালের হাজী আবদুল্লাহ লেন, নবাব ইউসুফ রোড, আজিমপুর নিউ পল্টন, আগামাসিহ লেন, আগাসাদেক রোড, সিদ্দিকবাজার, ইব্রাহিমপুর, খিলক্ষেতসহ অনেক এলাকা থেকে অভিযোগ আসছে।
পানি সংকটের জন্য রাজধানীবাসীরও দায় আছে। নিষিদ্ধ হলেও পানি টেনে নেওয়ার সাকিং মেশিন বসায় অনেক বাড়িতে। এতে সড়কের সামনের দিকের বাড়িগুলোতে পানি সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও পেছনের বাড়িগুলো পানি পায় না। অথচ এই মেশিন না থাকলে সবাই সমান পানি পেত। কিন্তু নিষিদ্ধ থাকলেও এ মেশিন বসানোর দায়ে কখনো কাউকে সাজা পেতে হয়নি।
ওয়াসা অবশ্য বলছে, নগরীর পানি সংকটের সমাধান কেবল একটি-দুটি বছরের পরিকল্পনা নয়, এর দীর্ঘমেয়াদি ও স্থানীয় সমাধানের জন্য কাজ চলছে। পদ্মা নদী থেকে পানি এনে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহের লক্ষ্যে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার জশলদিয়া পানি শোধনাগার স্থাপন করা হচ্ছে। ২০০২ সালে প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও অর্থসংস্থান করতে না পারায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়নি। তবে ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য চীনের সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। শোধনাগার নির্মাণ, ৩২ দশমিক ৪১ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানোসহ পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে দুই হাজার ৪১৩ কোটি টাকা ঋণ পাওয়া যাবে। এছাড়া ওয়াসা তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ২২ কোটি টাকা দেবে। বাকি এক হাজার ৭৪ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে। ২০১৬ সালের জুনে এ কাজ শেষ করার কথা রয়েছে।
মেঘনা পানি শোধনাগারের বিষয়ে ওয়াসা সূত্র জানায়, মেঘনা নদীর পানি শোধনাগার বাস্তবায়িত হলে এ প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হবে। এ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৬৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে ২৫ কোটি ডলার ঋণ দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফ্রান্সের ফ্রেঞ্চ ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (এএফডি) ১০ কোটি ডলার এবং ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ১০ কোটি ডলার দেবে। বাংলাদেশ সরকার অর্থায়ন করবে সাড়ে ২২ কোটি ডলার। আগামী ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।