হারিয়ে যাচ্ছে অতীত ইতিহাস করতোয়া
- এই দেশ এই সময়,ঢাকাঃ শুধু পরিচিতি আছে, আর কিছু নেই। আছে কেবল দূষণ আর দখল। দখলে দখলে মরা খাল। মরা খালের পর এখন শহরের সবচেয়ে বড় ড্রেন হয়েছে এক সময়ের খরস্রোতা বগুড়ার করতোয়া নদী। প্রায় পুরো করতোয়া নদী পানি দূষণ, পলি পড়ে ভরাট, নদীর বুকে চাষাবাদ, অস্থায়ী বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, ড্রেনের প্রবাহ, ময়লা অবর্জনা ফেলা, বালু উত্তোলন, কলকারখানার বর্জ্য ফেলাসহ নদীর দুই পাড় দখল হওয়ার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে করতোয়া, আর হারিয়ে যাচ্ছে অতীত ইতিহাস। নদীর প্রাণ ফেরাতে কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও সে সব প্রকল্পগুলোও আর আলোর মুখ দেখেনি। দিন দিন বাড়ছে দখল আর দূষণ।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ১২২ কিলোমিটার করতোয়া নদীর তীর ঘেঁষে প্রাচীন পুন্ড্রনগরীর গোড়া পত্তন হলেও সেই সভ্যতার সঙ্গে এখন করতোয়া নদীও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে চলেছে। নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলার নিচু জলাভূমি থেকে উৎপত্তি হয়েছে করতোয়া নদী। দিনাজপুরের পার্বতীপুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে রংপুরের বদরগঞ্জ, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ হয়ে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় প্রবেশ করেছে। করতোয়া নদী বগুড়া শহরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জেলার শেরপুর উপজেলার চান্দাইকোনা এলাকায় বাঙালি নদীতে গিয়ে মিলেছে। উৎপত্তিস্থল থেকে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২০০ কিলোমিটার। এরমধ্যে দখল আর ভরাটের কারণে এখন মরা নদী হিসেবে পরিণত হয়েছে প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা। প্রথম পর্যায়ে বগুড়া শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ১১ কিলোমিটারের নাব্যতা ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ফাইলবন্দী হয়ে আছে। স্বাধীনতার পর থেকেই করতোয়া নদী দখল শুরু হয়। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর বগুড়া শহরটি মডেল টাউনে পরিণত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। মডেল টাউনের প্রধান প্রকল্পটি ছিল বগুড়ার করতোয়া নদীকে দখলমুক্ত করে এবং নদীর দুই পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে দুই তীর দিয়ে পাকা সড়ক নির্মাণ করা। কিন্তু প্রভাবশালীদের কাছ থেকে দখলমুক্ত করা যায়নি নদী। তারা নদীর দুই পাশ ঘিরে যার যার মতো দখল করেছে। নির্মাণ করা হয়েছে শত শত বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিশাল বিশাল ভবন। ভবনগুলোর ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হয়েছে নদীর বুকে। এ ছাড়া বগুড়া পৌরসভার প্রধান প্রধান ড্রেনগুলো মিলিত হয়েছে করতোয়া নদীতে। শহরের আবর্জনা ও বিভিন্ন ক্লিনিকের বর্জ্য ফেলা হয় করতোয়ার বুকে। নদীর তলানিতে এখন রয়েছে শহরের ড্রেনের কালো পানি। বিভিন্নস্থানে বালু উত্তোলন চলছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন প্রতিরোধে জেলা প্রশাসন ও সদর উপজেলা প্রশাসন থেকে মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালনা করা হলেও বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি। বালু উত্তোলনকারীরা গড়ে তুলেছে একটি বিশাল চক্র। নদী থেকে অবৈধ উপায়ে বালু উত্তোলন করে কোটি কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে ওই চক্রটি। করতোয়া নদীর নাব্যতা ফিরে আনতে ২০০৭ সালে প্রথম একটি রিপোর্ট তৈরি করা হয়। রিপোর্টটি আলোর মুখ দেখেনি। ওই সময় নদীর দুই পাড়ে রাস্তা নির্মাণ, ড্রেজিং, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, ব্রিজ নির্মাণসহ সব মিলিয়ে প্রায় ১৩৬ কোটি টাকার বাজেটও পেশ করা হয়।
ওই রিপোর্টটি ২০১৩ সালের জুলাই মাসে সার্ভে করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু সেটিও আলোর মুখ দেখেনি। বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরকার জানান, করতোয়া নদীর নাব্যতা এবং পানি প্রবাহে একাধিকবার প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পগুলো আলোর মুখ দেখেনি। প্রস্তাবনাগুলো পাস করা হলে করতোয়া নদীর প্রাণ ফিরে পাবে। পরিবেশ অধিদফতর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের (কার্যালয় বগুড়ায়) সহকারী পরিচালক মেজবাবুল আলম জানান, করতোয়া নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে এবং দখলমুক্ত করতে কয়েক দফা চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে।