চলমান অপহরণ, নিখোঁজ, গুম বা গুপ্ত হত্যার দায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার: রিজভী
এই দেশ এই সময়,ঢাকাঃ সরকার আগামীকাল সোমবার অনুষ্ঠিতব্য ষষ্ঠ পর্যায়ের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আগের মতো বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার সব রকমের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদ।
রবিবার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই অভিযোগ করেন।
রিজভী আহমেদ বলেন, সোমবার অনুষ্ঠিতব্য উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল বিগত দিনের মতোই নিজেদের পক্ষে নিতে সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসছে ভোটের আগের দিনই ব্যালট দিয়ে ভোটবাঙ ভর্তি করে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের প্রচারণায় বাধা, হুমকি-ধামকি এমনকি হামলার ঘটনাও ঘটছে। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে রিজভী আহমেদ বলেন, এই মুহূর্তে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। বিনা বিচারে মানুষ হত্যা বন্ধ করতে হবে। অপহরণ-গুম-খুন এবং গুপ্তহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। র্যাবকে বিলুপ্ত করতে হবে।
রিজভী আহমেদ বলেন, এই সরকার জনগণের ম্যান্ডেটের পরোয়া করে না। গণতন্ত্রের অন্যতম মৌল উপাদান যে নির্বাচন তাতে তাদের বিশ্বাস নেই। আওয়ামী লীগ একদলীয় শাসনের উপাসক।
তিনি বলেন, জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছা ও জনগণের কাছে জবাবদিহিতা তাদের অভিধানে নেই। এরা নিজেরা গায়ের জোরে জবরদখল করা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জাতীয় সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করতেও চেষ্টার কমতি করছে না। এরা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির কড়াইশুদ্ধ খেয়ে ফেলেছে। এদের গণবিরোধী নীতির কারণেই সবদিক থেকে আধিপত্য ও আগ্রাসন থাবা বিস্তার করেছে।
রিজভী বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে দুঃসহ নৈরাজ্যকর কালো অমানিশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আওয়ামী লীগ সাড়ে ৫ বছর আগে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বেআইনি গুম, ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- অব্যাহত রেখেছে।
তিনি বলেন, বিনা বিচারে আটক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন তথাকথিত মহাজোট সরকারের ভয়ংকর রুদ্রশাসনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।
রিজভী বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পূর্বাপর সময়ে সরকারি অমানবিক অত্যাচারের মাত্রা তাদের অতীতের সকল রেকর্ডকে ভঙ্গ করেছে। সরকারি অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগ যেন এ যুগের ‘কাপালিক’। এলোপাতাড়ি মারধর, চাপাতি দিয়ে হত্যা, রক্তাক্ত জখম, অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, হল দখল, সিট বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, মুক্তিপণ আদায় এবং পরীক্ষা কেন্দ্র দখলে ছাত্রলীগের কর্মীরা এখন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।
তিনি বলেন, সর্বত্র সহিংস কর্মকা- করে জনগণকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য সশস্ত্র গডফাদারের আধিপত্য নিশ্চিত করাই এই সরকারের সবচাইতে বড় অবদান। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নতুন এক রূপ হচ্ছে গুম বা গুপ্তহত্যা।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, বাংলাদেশের চলমান অপহরণ, নিখোঁজ, গুম বা গুপ্ত হত্যার প্রায় অধিকাংশেরই দায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর। এ বিষয়ে দেশি-বিদেশি রাইটস গ্রুপগুলো সুষ্পষ্টভাবে উক্ত অমানবিক ঘটনাগুলোর বিষয়ে অভিযোগ করে এসেছে।
তিনি বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নামে সাদা পোশাকধারীরা বিরোধী দলের তরুণ যুবক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, শ্রমিক, ছাত্রসহ সাধারণ মানুষদেরও তুলে নিয়ে যায়।
রিজভী বলেন, কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর তাদের গলিত পচা লাশ নদীতে, খালে-বিলে, ধানক্ষেতে অথবা নির্জন লোকালয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এগুলোর বেশিরভাগ ঘটনায় অপহৃত, নিখোঁজ ও নিহতদের পরিবার আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে বিশেষভাবে র্যাবের বিরুদ্ধে এসব ঘটনার অভিযোগ তুললেও সরকার নির্লিপ্ত থাকে।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে সরকার কখনোই কোনো প্রেসনোট দেয়নি বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
এডভোকেট রিজভী বলেন, কাউকে নির্বাচিত করার অধিকারের পাশাপাশি কাউকে পরাজিত করার অধিকারও জনগণের রয়েছে। জনগণের সেই অধিকার এখন আওয়ামী লীগ ডাকাতি করে কেড়ে নিয়েছে। বহুর মধ্যে গণতন্ত্রের যে বীজ উপ্ত থাকে সেই বীজকে তারা নষ্ট করে দিয়েছে। সেজন্য গণতন্ত্রের যে মূল সারাৎসার, বিবেক, চিন্তা, কথা বলার যে স্বাধীনতা তা তারা হিংসাত্মক নিষ্ঠুরতায় দমন করে চলেছে।
তিনি বলেন, গণমাধ্যমে নীরব নিষেধাজ্ঞা চলছে, টিভির টকশোর ব্যাপারে বিধি-নিষেধ, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন নেতারা গণমাধ্যমে অযৌক্তিক, অশালীন উক্তি, বিরোধী দলের সমাবেশে সরাসরি সমপ্রচার বন্ধ করে দেয়া, ইন্টারনেট, ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ ও চোখ রাঙানির মাধ্যমে গণতন্ত্রের যে মৌলনীতি মত প্রকাশের স্বাধীনতা তা খর্ব করা। এভাবেই সরকারি পেষণযন্ত্র জনগণের টুঁটি চেপে ধরেছে।
রিজভী বলেন, এই অবৈধ সরকার এখন গলাচিপা সরকার। আর এই দমন পীড়ন সুচারুভাবে সম্পন্ন করতেই র্যাবের অবৈধ ও নিষ্ঠুর কর্মকা-ের যাত্রাপথে কোনো স্প্রিড ব্রেকার দেয়া হয়নি। আর এ কারণেই র্যাব হত্যা গুম ও অপহরণের মূর্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছে। তাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এক নতুন ফ্রাংকেনস্টাইনের দানবের নাম র্যাব।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় মদদ না থাকলে শুধু নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ৭ খুনই নয়, দেশব্যাপী বেআইনি গুম, অপহরণ ও গুপ্তহত্যার এই মহাযজ্ঞ চলতো না। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় নুর হোসেনের কাছ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হতেই র্যাব কর্মকর্তারা এই সর্বনাশা নিষ্ঠুর কাজে নিয়োজিত হয় বলে গণশুনানিতে অনেকেই অভিযোগ করছেন।
রিজভী বলেন, পত্রিকার সংবাদে বলা হয়- ৭ জনের খুনের ঘটনায় পা বাঁধা, পেট কাটা, ইটপুরা অবস্থায় বস্তাবন্দী লাশগুলো উদ্ধারের পর যে ধরনের ইটপুরে বস্তাবন্দী লাশ ডোবানো হয়েছিল একই ধরনের ইট পড়ে আছে নারায়ণগঞ্জ র্যাব-১১ দফতরের পাশে।
তিনি বলেন, অভিযুক্ত র্যাবের কর্মকর্তাদের গ্রেফতার নিয়ে যে দীর্ঘসূত্রতা দেখা গেছে তাতে এটি আর সন্দেহের পর্যায়ে নেই, সরকারের মদতের বিষয়টি দিনের আলোর ন্যায় সুষ্পষ্ট।
রিজভী বলেন, প্রশাসন না চাইলে গডফাদাররা এক মুহূর্তের জন্যই টিকতো না। নুর হোসেনের টাকার লোভে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা হাড়হিম করা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। অর্থের জন্য র্যাব কর্মকর্তারা বিবেকবর্জিত আত্মসমর্পণ করার কারণেই নুর হোসেনদের মতো গডফাদারদের উৎপত্তি হয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের সকল মাফিয়া ডনদের উৎপত্তির পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়া। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ দলকানা প্রশাসনযন্ত্রের ভেতরেই চিরুনি অভিযান চালালেই জানা যাবে ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, লাকসামের হিরু ও হুমায়ুনসহ অগণিত গুম হয়ে যাওয়া মানুষের পরিণতি।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আব্দুস সালাম, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর সরাফত আলী সফু প্রমুখ।