চলন্ত সিঁড়িতে ওঠার অভ্যাস নেই তেমন
কাজী আমিনুল হাসানঃ রাজধানীর বনানীতে সড়ক পার হবেন আসমা আক্তার। দাঁড়িয়ে আছেন ফুটওভার ব্রিজের নিচে। ওঠতে ভয় পাচ্ছেন তিনি। কেন দাঁড়িয়ে আছেন? জানতে চাইলে আসমা বলেন, ‘চলন্ত সিঁড়িতে ওঠার অভ্যাস নেই তেমন। একটু দেখার চেষ্টা করছি কীভাবে মানুষ ওঠে।’
দেশের প্রথম চলন্ত সিঁড়ির ফুটওভার ব্রিজকে ঘিরে আসমার মতোই এ রকম ‘বিড়ম্বনায়’ পড়তে দেখা গেল সব বয়সী মানুষকেই। সিঁড়ি চলছে, পা দিলে সামনে টেনে নিয়ে যায়, পেছনের পা হয়ে পড়ে ভারসাম্যহীন। আবার পা পিছলে পড়ে যাবে কি না মনে আছে এই ভয়। তাই অন্যরা কীভাবে সিঁড়িতে চড়ে তা দেখেই ওঠেন তারা।
ঢাকার বিভিন্ন মোড়ে ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও তাতে ওঠতে চায় না পথচারীরা। ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে বা হেঁটে রাস্তা পারাপার হয় অনেক মানুষ। এতে নানা সময় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটেছে। এই সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে তা জানা নেই পুলিশের। সিঁড়ি ভেঙে কষ্ট করে মানুষ ফুটওভার ব্রিজে উঠতে চায় না এই বিষয়টি মাথায় রেখে পথচারীদের স্বাচ্ছন্দ্য দিতেই গত এপ্রিল থেকে বনানীর সৈনিক গেট সংলগ্ন এই ফুটওভার ব্রিজটি করা হয়েছে, যেখানে লাগানো হয়েছে এস্কেলেটর বা চলন্ত সিঁড়ি।
পথচারীদের কষ্ট কম হওয়ায় এর ব্যবহারকারীরা খুশি। এই এলাকায় এখন আর মানুষকে দৌড়ে রাস্তা পার হতে দেখা যায় না।
প্রতি মিনিটেই পাঁচ থেকে দশজন করে পথচারী এই ফুটওভার ব্রিজটি ব্যবহার করছে। অফিস শুরুর আগে বা ছুটি শেষে এই সংখ্যা বাড়ে কয়েক গুণ। সিঁড়িটি শিশু এবং প্রবীণদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এই ফুটওভার ব্রিজটি স্থাপনে সিটি করপোরেশনকে ধন্যবাদও জানালেন কেউ কেউ।
৬৮ বছর বয়স হয়েছে ফজলুর রহমান ভূঁইয়ার। এই বয়সে হাঁটাচলা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। সড়কে যখন দ্রুতগতিতে চলে শত শত গাড়ি তখন রাস্তা পারাপারে ভয় লাগে। তার সেই ভয় থাকে না বনানীর এই এলাকায় এলে। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘বয়স্কদের জন্য এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। বয়স হওয়ায় হাঁটুতে শক্তি পাই না। তাই সাধারণ সিঁড়িতে ওঠতে অনেক কষ্ট হয়। শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। তাই ফুট ওভারব্রিজগুলো আমি ব্যবহার করি না। আবার নিচ দিয়ে রাস্তা পার হতে লাগে ভয়। এখানে সেটা নেই। সবগুলো ফুটওভার ব্রিজ যদি এমন হতো, তাহলে আমার মতো মানুষ খুব উপকার পেতো।’
কচুক্ষেতের বাসিন্দা সাগরিকা বলেন, ‘ফুটওভার ব্রিজে ওঠতে কষ্ট হতো বলে আগে তা ব্যবহার না করে নিচ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতাম। চলন্ত সিঁড়ি হওয়ায় এখন আর সেভাবে রাস্তা পার হই না। প্রথমে সিঁড়িতে ওঠতে ভয় পেতাম। কিন্তু এখন জানি কীভাবে উঠতে হয়।’
শিশুদের কাছে সিঁড়িটি আনন্দের উপকরণ। মিনারা, রুমি, রাশিদা নামের তিন শিশুকে দেখা গেল চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে বারবার উঠছে-নামছে। মিনারা বলল, ‘এটাতে ওঠতে ভালো লাগে। নানীর বাড়িতে এলেই এখানে আসি।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘বিশুদ্ধ বায়ু, পরিবেশ ও টেকসই’ প্রকল্পের আওতায় এই ফুটওভার ব্রিজটি তৈরি করা হয়েছে। এতে খরচ হচ্ছে প্রায় পৌনে ৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু সিঁড়ির (এস্কেলেটর) দামই এক কোটি টাকা। মালয়েশিয়ার মাশিবা কোম্পানি থেকে এই চলন্ত সিঁড়ি আনা হচ্ছে। এর ধারণক্ষমতা প্রতি ঘণ্টায় ৬ হাজার ৭৫০ জন। এ ধরনের ফুটওভার ব্রিজ রাজধানীতে আরও করা হবে বলেও জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবুল খায়ের ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এটা একটা পাইলট প্রকল্প। পরীক্ষামূলকভাবে এটি বসানো হয়েছে। এখন আমরা এটি পর্যবেক্ষণ করছি। ৬ মাস পর্যন্ত দেখব জনগণের ব্যবহার বাড়ছে না কমছে। তাছাড়া বৃষ্টিতে ভিজে কোনো সমস্যা হয় কি না, কোনো দুর্ঘটনা যেন না ঘটে এসব বিষয়ে লক্ষ্য রেখে পরে আর কোথায় একই ধরনের ফুটওভার ব্রিজের কাজ ধরব।’
সিটি করপোরেশনের এই কর্মকর্তা জানান, এরপর রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় তিনটি, মিরপুর ১ ও ১০ নম্বর সেকশন এবং বিমানবন্দর এলাকায়ও একই ধরনের ফুটওভার ব্রিজ করার পরিকল্পনা আছে।
এছাড়া সোনারগাঁও জনপথ মোড়, কল্যাণপুর, অফিসার্স ক্লাব, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, নিউমার্কেট, শাহবাগ এলাকায়ও পর্যায়ক্রমে চলন্ত সিঁড়িযুক্ত ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। তবে যেসব জায়গায় উড়ন্ত সড়ক বা এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে তৈরি হবে সেসব জায়গা এ পরিকল্পনা থেকে বাদ দেওয়া হবে।
মোট কতগুলো চলন্ত সিঁড়ির ওভারব্রিজ করা হবে¬¬Ñজানতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবুল খায়ের বলেন, ঢাকায় বেশ কিছু ফুটওভার ব্রিজের বয়স ২৫ বছর বা এর চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। এগুলোতে চলন্ত সিঁড়ি লাগানো হবে নাকি ভেঙে নতুন করে তৈরি করা হবে সে বিষয়েও চিন্তা-ভাবনা চলছে। পুরো বিষয়টি বরাদ্দের ওপর নির্ভর করবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে ঢাকায় উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে সব মিলিয়ে আরও ২৩টি সাধারণ ফুটওভার ব্রিজের কাজ করা হবে বলে এর আগে ডিসিসির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরে ১৩টি এবং দক্ষিণে ১০টি ব্রিজ তৈরি করা হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পিআরও মনোয়ার হোসেন জানান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মোট ৫২টি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি রয়েছে কেইস প্রকল্পের আওতায়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা উত্তম কুমার জানান, দক্ষিণে ২৯টির মতো ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। তবে দক্ষিণে চলন্ত সিঁড়ি বসানোর পরিকল্পনা আপাতত নেই বলে তিনি জানান।
কখন চালু থাকে
বৈদ্যুতিকচালিত এ চলন্ত সিঁড়ি চালু ও বন্ধ করা এবং সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য শরিফুল ইসলাম ও দিদার বক্স নামে দুই নিরাপত্তা কর্মী রয়েছে। নিরাপত্তাকর্মী মো. শরিফুল ইসলাম এই দেশ এই সময়-এর সঙ্গে আলাপকালে বলেন, সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত এটি চালু থাকে। জেনারেটরের ব্যবস্থা না থাকায় বিদ্যুৎ চলে গেলে এটি বন্ধ থাকে। দিনে তিন থেকে চারবার বিদ্যুৎ চলে যায়।
সাধারণত সকাল সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত এবং বিকাল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত প্রচুর পথযাত্রী এই ফুটওভার ব্রিজটি ব্যবহার করে বলে জানান শরিফুল।
তবে চলন্ত সিঁড়ির ব্যবহার না জানার কারণে এ পর্যন্ত ছোটখাটো দুর্ঘটনাও কম হয়নি। অনেকেই ওঠতে গিয়ে পড়ে যান। এ ব্যাপারে পথচারীদের সঠিক নির্দেশনা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখার পরামর্শও দিয়েছেন একজন পথচারী।
সাধারণ ফুটওভার ব্রিজে ওঠতে পথচারীদের অনীহা
রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা বাংলামোটর মোড়েই আছে একটি ফুটওভার ব্রিজ। দিনরাত দ্রুতগতিতে চলে গাড়ি। এর মধ্যেই নানা কায়দা করে দৌড়ে পার হতে দেখা যায় পথচারীদের। পাশেই নিরাপদে চলাচলের জন্য ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও কেন ব্যবহার করেন নাÑ জানতে চাইলে পথচারীরা লজ্জার হাসি দিয়েই জবাব দেয়ার চেষ্টা করলেন।
বাংলামোটরে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা বললেন হতাশার কথাই। একজন বললেন, ‘এত মানুষকে কীভাবে বাধ্য করব? মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হলেও সারাক্ষণ এটা চালানো তো সম্ভব নয়। আমরা যান চলাচলের শৃঙ্খলা দেখব নাকি মানুষকে সামলাব।’
পথচারীদের এই প্রবণতায় নাখোশ গাড়ি চালকরা। কারণ দ্রুতগতিতে চালানোর সময় চট করে সামনে কেউ পড়ে গেলে গাড়ি সামলানো এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এই বাংলামোটরে এভাবে রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে একাধিক মানুষের মৃত্যুও হয়েছে।
পাশে পরীবাগেও আছে আরেকটি ফুটওভার ব্রিজ। পথচারীরা যাতে দৌড়ে পার হতে না পারে সে জন্য সড়কে দেওয়া আছে লোহার রেলিং। কিন্তু দুটি রেলিংয়ের মাঝে আছে একটি বড় ফাঁকা জায়গা। ফুটওভার ব্রিজের বদলে এখান দিয়েই পার হতে দেখা যায় বেশ কিছু পথচারীকে। আর নিউমার্কেট এলাকায় এই লোহার রেলিং টপকে যেতে দেখা যায় পথচারীদের। কোথাও কোথাও রেলিং ভেঙে ফেলেছে পথচারীরা।
সেনাসমর্থিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢাকায় বিশৃঙ্খলভাবে রাস্তা পারাপারে পাঁচ টাকা জরিমানার বিধান চালু করা হয়। কিন্তু তা চালু থাকেনি বেশিদিন।