রাতের ঢাকায় আতঙ্কে নাইটকোচ যাত্রীরা
রাতের বেলা ঢাকায় সবচেয়ে বেশি দুর্বিপাকে পড়েন দূরপাল্লার বাসে যারা গভীর রাতে এসে বাসস্ট্যান্ডে নামেন। নাইটকোচে ভ্রমণে রাত জাগার ক্লান্তি নিয়ে তাদের সূর্যের আলো ফোটার অপেক্ষা করতে হয়। বাসায় নিশ্চিন্ত ঘুমের বিছানা অপক্ষো করলেও ছিনতাইয়ের ভয়ে সবাই আটকে থাকেন বাসস্ট্যান্ডে। সিএনজি অটোরিকশা পাওয়া যায়, চলে কিছু যাত্রীবাহী লোকাল বাস; কিন্তু সেসবে চড়বার ভরসা পান না কেউ। বাস কাউন্টারগুলোর সামনে টহল পুলিশের সার্বক্ষণিক তদারকি থাকলেও চলতি পথে টহল পুলিশের গতিবিধি কম থাকার অভিযোগ দেখালেন যাত্রীরা। তারা বললেন, ছিনতাইকারীর কবলে পড়লে সব হারাতে হবে। তারচেয়ে কাউন্টারে বসে থাকার দুর্ভোগ ভাল। ছিনতাইকারীদের আতঙ্কে যাত্রীরা আটকে থাকেন বাস কাউন্টারগুলোতে।
সাধারণ, নিরীহ মানুষগুলোকে নিরাপত্তা দিতে টহল দেয় পুলিশের নিরাপত্তা বাহিনী। রাতের ঢাকায় নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি থানা এলাকায় পুলিশের পর্যাপ্ত টহল এবং চেকপোস্ট থাকার কথা থাকলেও বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। রাজধানীর প্রধান প্রধান রাস্তায় পুলিশের টহল থাকলেও পাড়া-মহল্লায় তা থাকে না। ফলে রাতের বেলা প্রয়োজনে চলাচলকারী নাগরিকরা ভোগেন চরম নিরাপত্তাহীনতায়। রাতের বেলা রাজধানীর কল্যাণপুর, কলাবাগান, সায়েদাবাদ এলাকার বিভিন্ন বাস কাউন্টার ঘুরে দেখা গেছে, সারাদেশ থেকে আসা যাত্রীরা কেউই বাসায় যাননি। সবাই কাউন্টারে অপেক্ষা করছেন। কাউন্টারের খুব কাছে-পিঠে যাদের বাসা তারা ঝুঁকি নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেও দূরের যাত্রীরা কেউ-ই সে ঝুঁকি নিতে নারাজ।
চলতি পথে ছিনতাই তো খুব স্বাভাবিক ঘটনা, এমনকি কাউন্টারে দলবল নিয়ে এসে ডাকাতির ঘটনাও ঘটেছে। গত বছর ঈদের সময় কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে একদল দুর্বৃত্ত অস্ত্রের মুখে সব যাত্রীর লাগেজ উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে বাস কাউন্টারগুলোতে অপক্ষেমাণ যাত্রীরাও ভুগছেন আতঙ্কে।
কল্যাণপুরে ‘শ্যামলী’ বাস কাউন্টারের ম্যানেজার সুশীল ভদ্র বললেন, শুধু শ্যামলীর যাত্রীরাই নন, অন্যান্য বাসের যাত্রীরাও এখানে এসে অপেক্ষা করেন। যদিও কল্যাণপুরে এখন পর্যন্ত যাত্রীদের লাগেজ ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি, তবে আমরা সাবধান থাকি। টহল পুলিশও সবসময় থাকে এখানে। তবে তিনি স্বীকার করেন, দূরপাল্লার এই যাত্রীদের দুর্ভোগ ঘোচানোর একটা উপায় খোঁজা জরুরি।
রাত সোয়া তিনটার দিকে কুষ্টিয়া থেকে স্ত্রী ও ছোট বাচ্চা নিয়ে কল্যাণপুরে বাস থেকে নেমেছেন আলমগীর হোসেন। যাবেন যাত্রাবাড়ী। তিনি বললেন, গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী একটা বাস সারারাত যাতায়াত করে; কিন্তু কাউন্টারের লোকজন এত রাতে বাসে উঠতে মানা করেছে। তাই তিনি সকাল হওয়ার অপেক্ষা করছেন। এখানকার চা-দোকানি রাসেল বললেন, টাউন সার্ভিস বাস চললেও রাতে এইসব বাসে না ওঠাই ভাল। বাসের ড্রাইভারদের সঙ্গে ছিনতাইকারীদের যোগাযোগ থাকে। ওরা কাওরান বাজারের পরে বাসে উঠে যাত্রীদের সবকিছু কেড়ে নেয়। সব হারানোর ঝুঁকি নেয়ার চাইতে এখানে বসে থাকা ভাল।
চট্টগ্রাম থেকে মালিবাগ এসে নেমেছেন নওশাদ করিম। ব্যবসার কাজে এসেছেন তিনি। বললেন, এত রাতে কোন একটা হোটেলে উঠবেন। তিনি বললেন, এত রাতে ঝুঁকি নেয়ার কোন মানে হয় না। আমি দুইবার রাতে ফিরে আত্মীয়ের বাসায় যাবার সময় ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছি। টাকা, ব্যাগ সব গেছে। এরপর আর নাইট কোচে জার্নি করলে কারো বাসায় যাই না। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের আশেপাশের হোটেলগুলোতে থেকে যাই।
এরকম ছিনতাইয়ের ঘটনা শোনালেন অনেক যাত্রীই। সিএনজি অটোরিশাতে গেলেও ছিনতাইয়ের শিকার হতে হয়েছে অনেককেই। রাতে ফাঁকা জায়গা দেখে অটোরিকশা ‘নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর’ ছিনতাইকারীরা অস্ত্রের মুখে দরজা খুলতে বাধ্য করে যাত্রীদের। এরপর ব্যাগ, মোবাইল ফোন নিয়ে চম্পট দেয় তারা। এমনই ঘটনার শিকার হয়েছেন জিগাতলার মিতালী রোডের বাসিন্দা এরফান সাঈদ। তিনি বললেন, লেকসার্কাসে বাস থেকে নেমে বাসায় ফিরছি। ৭/এ রোডে এসে অটোরিকশা বন্ধ হয়ে যায়। ড্রাইভার বাইরে বের হয়ে পেছনে যায় ঠিক করার জন্য, এই সময় কয়েকজন এসে ঘিরে ফেলে আমাকে। সবকিছু কেড়ে নিয়ে আমাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে চলে যায় তারা। তবে এ ঘটনা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেননি তিনি। বললেন, কি লাভ! তাদের কি আর খুঁজে বের করতে পারবে পুলিশ। আর অটোরিকশা থেকে ব্যাগ নিয়ে যাওয়া তো কোন বিষয়ই না। মোহাম্মদপুর, আদাবর, ধানমন্ডি, খিলগাঁও, শাহজাহানপুর এসব এলাকায় রাতের যাত্রীদের ছিনতাইয়ের শিকার হতে হচ্ছে হর-হামেশা।
আইন-শৃংখলা বাহিনীর কারণে বড় ধরনের বিপদ থেকে বেঁচে গেছেন এমন কথাও জানালেন কেউ কেউ। রংপুর থেকে নাইটকোচে ঢাকায় নেমে সিএনজি নিয়ে মুগদাপাড়া যাচ্ছিলেন তানজিবুল আলম। পথে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। গুলশানে শুটিং ক্লাবের সামনে পুলিশ বক্সে অটোরিকশা দাঁড়ালে তার ঘুম ভাঙে। দেখেন যে, অটোরিকশা চালক তাকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পুলিশের চেকপোস্টে আটকানোর জন্য বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন তিনি।
রাতে ঢাকার নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি থানা এলাকায় প্রয়োজন পর্যাপ্ত পুলিশ টহল এবং চেকপোস্ট; কিন্তু রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরলে পুলিশের চেকপোস্ট খুব একটা চোখে পড়ে না। এ ব্যাপারে শুক্রবার রাতে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য জানান, বর্তমানে রাতে টহল ও তল্লাশি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ টহল পুলিশ বা চেকপোস্টের ওপর হামলা চালাতে দ্বিধাবোধ করে না দুর্বৃত্তরা।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অভিজাত এলাকা গুলশান, বারিধারা, ডিওএইচএস, বনানী ও উত্তরার কিছু অংশ ছাড়া অন্য এলাকায় পুলিশ পাহারা চলে ঢিলেঢালাভাবে। রাজধানীর এয়ারপোর্ট রোড, জোয়ার সাহারা, খিলক্ষেত, বিশ্বরোড, রামপুরা, মৌচাক, মালিবাগ, মগবাজার, মহাখালী, সাতরাস্তা, এফডিসি, বেইলি রোড, রমনা, মিন্টো রোড, মত্স্য ভবন, হাইকোর্ট, দোয়েল চত্বর, টিএসসি, কাঁটাবন, আজিমপুর, ধানমন্ডি, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, চকবাজার, মিটফোর্ড, ইসলামপুর, উয়ারী, সূত্রাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, চিটাগাং রোড, নিউমার্কেট, মিরপুর রোড পর্যন্ত এলাকাগুলোর কিছু কিছু স্থানে অল্প সময়ের জন্য পুলিশ পাহারা বা চেকপোস্ট থাকলেও বেশিরভাগ সময় থাকে অরক্ষিত। তবে গাবতলী থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত পুলিশ প্রহরা বেশ জোরদার থাকে।