নিউ ইয়র্কে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ‘রহস্যপুরুষ দাদাভাই’
রোকন ঊদ্দিন, ঢাকা: বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খান নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এখন নিউ ইয়র্কের এলমহার্স্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে রহস্যপুরুষ বলে খ্যাত চিরকুমার এ নেতাকে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।রোববার বিকেলে তিনি কিছুটা সুস্থ বোধ করছেন বলে জানা গেছে। হাসপাতালের ষষ্ঠ তলায় চিকিৎসাধীন সিরাজুল আলম খান সাক্ষাৎপ্রার্থীদের জানান, তার ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছিল। তা দূর হলেও নিউমোনিয়ায় তাকে বেশি কাহিল করে ফেলেছে। এ জন্য কথা বলতে এমনকি শ্বাস নিতেও প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র জাসদের নেতা-কর্মীরা তার খোঁজখবর রাখছেন।
৭৩ বছর বয়সী ‘দাদাভাই’ নিউ ইয়র্কে যান গত ২০ জুলাই। এর পর থেকে নিউ ইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটস এলাকায় জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা মাসুম মোহাম্মদ মহসিনের বাসায় অবস্থান করছিলেন তিনি।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী সিরাজুল আলম খান মেধাবী ছাত্র হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৩-৬৪ এবং ১৯৬৪-৬৫ এই দুই বছর তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২ সালের গঠিত নিউক্লিয়াস ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামেও পরিচিত ছিল। এটি গঠনের উদ্যোগে তার প্রধান সহকর্মী ছিলেন আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ।
১৯৬২-৭১ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন করে এই ‘নিউক্লিয়াস’। আন্দোলনের একপর্যায়ে গড়ে তোলা হয় ‘নিউক্লিয়াস’-এর রাজনৈতিক উইং বিএলএফ এবং সামরিক ‘জয় বাংলা বাহিনী’। স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে ‘জয় বাংলা’সহ সব স্লোগান নির্ধারণ এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাক্যসমূহের সংযোজনের কৃতিত্ব ‘নিউক্লিয়াসে’র। এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা ছিল মুখ্য।
১৯৬৯-৭০ সালে গণ-আন্দোলনের চাপে ভেঙে পড়া পাকিস্তানি শাসনের সমান্তরালে ‘নিউক্লিয়াসের’ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংগঠন করা হয় ছাত্র-ব্রিগেড, যুব-ব্রিগেড, শ্রমিক-ব্রিগেড, নারী-ব্রিগেড, কৃষক-ব্রিগেড, সার্জেন্ট জহুর বাহিনী। এদের সদস্যরাও ভেঙে পড়া পাকিস্তানি শাসনের পরিবর্তে যানবাহন চলাচল, ট্রেন-স্টিমার চালু রাখা, শিল্প-কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখা এবং থানা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করে।
নিউক্লিয়াসের সদস্যদের দ্বারা এইসব দুরূহ কাজ সম্পাদনের জন্য কৌশল ও পরিকল্পনাও নিউক্লিয়াসের। ১৯৭০-৭১ সাল নাগাদ বিএলএফের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজারে। এদের প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উন্নত সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত হন এবং ‘মুজিব বাহিনী’ নামে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনসহ ১১টি সেক্টরের পাশাপাশি ৪টি সেক্টরে বিভক্ত করে বিএলএফের সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা ও কৌশল ছিল কেবল ভিন্ন ধরনের নয়, অনেক উন্নতমানের এবং বিজ্ঞানসম্মত।
বিএলএফের চার প্রধান ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জক ও তোফায়েল আহমেদ। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী সভা স্থগিত ঘোষণার পরপরই ২ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত নির্ধারণসহ ৩ মার্চ ‘স্বাধীন বাংলার ইশতেহার’ ঘোষণার পরিকল্পনাও ছিল এই নিউক্লিয়াসের। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে এই দুটি কাজ ছিল প্রথম দিকনির্দেশনা। আর এই দুই গুরুদায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের নির্বাচিত করার দায়িত্ব পালন করে বিএলএফ। নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণ-আন্দোলনে গড়ে ওঠা জনমতকে সাংবিধানিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে গণরায়ে পরিণত করার এই কৌশলও নির্ধারণ করে বিএলএফ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সানন্দে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেন। আন্দোলন, নির্বাচন, সমান্তরাল প্রশাসন এবং আসন্ন সশস্ত্র সংগ্রামকে হিসেবে নিয়ে বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তোলার কৃতিত্ব সিরাজুল আলম খানের।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর আন্দোলন-সংগ্রামের রূপ ও চরিত্র বদলে যায়। গড়ে ওঠে একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ‘সিপাহি জনতার গণ-অভ্যুত্থান’ বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। জাসদ গঠন এবং ‘সিপাহি জনতার গণ-অভ্যুত্থান’ এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আর এই দুটি বৃহৎ ঘটনার নায়ক ছিলেন মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব এবং কর্নেল আবু তাহের।
সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় সাত বছর কারাভোগ করেন। সিরাজুল আলম খানের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অঙ্কশাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেলজীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওপর গড়ে ওঠে তার অগাধ পাণ্ডিত্য এবং দক্ষতা। সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের অসকস বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আর্থসামাজিক বিশ্লেষণে সিরাজুল আলম খানের তাত্ত্বিক উদ্ভাবন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়। মার্ক্সীয় ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের আলোকে বাংলাদেশের জনগণকে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী হিসেবে বিভক্ত করে ‘রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক’ মডেল হাজির করেছেন সিরাজুল আলম খান। চিরাচরিত পার্লামেন্টারি ধাঁচের ‘অঞ্চলভিত্তিক’ প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি শ্রম, কর্ম, পেশায় নিয়োজিত সমাজ শক্তিসমূহের ‘বিষয়ভিত্তিক’ প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থাসংবলিত ‘দুই কক্ষ’ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন, ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন এবং প্রাদেশিক সরকার গঠন, উপজেলা পর্যায়ে স্বশাসিত স্থানীয় সরকার পদ্ধতি চালু করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আইন ব্যবসা ও শাসনকাঠামোর পরিবর্তে স্বাধীন দেশের উপযোগী শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার মডেল উত্থাপন করেন তিনি।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের স্বীকৃতির প্রয়োজনও তার চিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশকে শিল্পায়ন করার লক্ষ্যে প্রবাসীদের অর্থায়নে ‘উপজেলা শিল্প এলাকা’ এবং ‘পৌর শিল্প এলাকা’ গঠন করার প্রস্তাব ইতিমধ্যেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘মাইক্রোক্রেডিট’ ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং ‘সামাজিক ব্যবসা’র সমর্থক তিনি।
তার দীর্ঘ ৫৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য ছাত্র-যুব নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক এক বিস্ময়কর ব্যাপার। রাজনৈতিক তত্ত্ব উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন মডেল প্রণয়নে তার প্রধান সহযোগীরা হলেন ড. জিল্লুর রহমান খান, প্রফেসর রাজিয়া আহমেদ ও মহিউদ্দিন আহমদ।