দশমিনার বীজ বর্ধন খামার বদলে দেবে দক্ষিণাঞ্চল
পটুয়াখালী প্রতিনিধি,এইদেশ এইসময় : ‘মোরা খালি ধান আবাদ করি। অন্য কোন জমি- জিরাইতে মোগও আগ্রহ নাই। এহানকার বাজারে আর কোন বীজও পাই না। মোরা ধারণাও করতে পারি নাই, এই চরের জমিগুলা বহুফসলি। এইহ্যানে খামার হওয়ার পর মোগও ধ্যান-ধারণা পাইল্টা গেছে। এহন আর বছরের আধা সময় খালি-খালি জমি পইরা থাকবে না’।
কথাগুলো বলছিলেন পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার বাঁশবাড়িয়া গ্রামের কৃষক ইমাম হোসেন সরদার। তিনি তার নিজের ভাষায় আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘তার স্ব-উপজেলার তেতুঁলিয়ার চর বেষ্টিত দশমিনা বীজ উৎপাদন উপযোগী খামারের কথা।’
পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব কোনে বাঁশবাড়িয়া লঞ্চঘাট। ওই লঞ্চঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ১৪ থেকে ১৬ মিনিটের পথ। তেঁতুলিয়া নদী পার হয়ে বীজ উৎপাদন খামারটির অবস্থান।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল খামারের চিত্র। চার পাশ জুড়ে সবুজ শস্যের ক্ষেত। কৃষকদের কেউ নিড়ানি, কেউ সেচ, আবার কেউ মাড়াইকাজে ব্যস্ত।
খামারের কর্মকর্তারা জানান, এলাকার কৃষকরা শস্য বলতে শুধু ধানকে বোঝে। কিন্তু কর্মকর্তারা এটা বদলে দিতে চাচ্ছেন। কৃষক স্বপ্ন দেখবে সূর্যমুখী ফুল। সূর্যের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে হাসবে তা, যা থেকে উৎপাদন হবে তেল। বালুচরে থাকবে সারি সারি ভুট্টা গাছ। সেখানে ঝুলবে থোকায় থোকায় ভুট্টা। যে মাটিতে পাট আবাদ ছিল অকল্পনীয়, সেখানে উৎপাদন হবে সোনালি আঁশ। হবে গম, আলু। সবই হবে লবণসহিষ্ণু বীজে।
খামার সূত্র জানায়, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) বীজ উৎপাদন খামারটি তৈরির উদ্যোগ নেয়। এ জন্য দশমিনা উপজেলার চর বাঁশবাড়িয়া ও চর বোতামে ১০৪৪ দশমিক ৪৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালের ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ খামারের উদ্বোধন করেন। ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হয় বীজ উৎপাদন খামারের কার্যক্রম। এতে অর্থের জোগান দিচ্ছে যৌথভাবে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। গত আমন মৌসুমে খামারে প্রায় ১৫ জাতের ধান আবাদ করা হয়। উৎপাদন হয় প্রায় ৩শ মেট্রিক টন ধানবীজ।
সূত্রটি আরো জানায়, স্থানীয় আবহাওয়ার সঙ্গে সহনশীল ও বাম্পার ফলনের প্রত্যাশায় আফ্রিকান জাত নেরিকা ১, নেরিকা ১০ ও নিউট্যান্ট প্রজাতির ধান বীজের চাষ হচ্ছে। খামারে উৎপাদিত বীজ এ বছর থেকে দক্ষিণাঞ্চলের ছয় জেলার কৃষকদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হবে। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের বিখ্যাত সুগন্ধি কালিজিরা ও বাঁশফুল বালাম বীজ পৌঁছে দেওয়া হবে সারা দেশে।
খামারের কর্মকর্তারা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী ও ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তাই ধান চাষ যাতে বাধাগ্রস্থ না হয় সে জন্য ব্রি ধান ৪৭, বিনা ধান ১০, বিনা ধান ৭ ও ব্রি ধান ৫৩ আবাদ হচ্ছে। এসব জাত থেকে উৎপাদন হচ্ছে বিপুল পরিমাণ লবণসহিষ্ণু ধানবীজ। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের আবহাওয়ায় যেসব ফসল উৎপাদন কৃষকের জন্য লাভজনক হবে গবেষণার মাধ্যমে সেসব বীজ উৎপাদন করা হবে।
এ ব্যাপারে দশমিনা বীজ উৎপাদন খামারের প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ মিজানুর রহমান জানান, এখানে উৎপাদিত ধানের ফলন যেমন ভালো তেমন বীজের গুণগত মানও সন্তোষজনক। এখানে উৎপাদিত ধানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, খড়া, বন্যা ও লবণসহিষ্ণু।
বিএডিসির সদস্য পরিচালক মো. নুরুজ্জামান জানান, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে এ খামার কাজ করছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. এস এম নাজমুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, দশমিনার খামার থেকে এ অঞ্চলের কৃষকদের নতুন নতুন জাতের ধানবীজ ও প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়া হবে।