পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা
ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কঃ পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশে আবার কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা দিয়েছে। সরকারের পতন ঘটাতে রাজধানী ইসলামাবাদ অভিমুখে পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই) ও পাকিস্তান আওয়ামি তেহরিক (পিএটি) লংমার্চ করে সেখানে বিক্ষোভ করছে। দাবি আদায়ে ক্রিকেট তারকা থেকে রাজনীতিতে আগত ইমরান খান ও তার দলের ৩৪ জন পার্লামেন্ট সদস্য ইতোমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন। ইমরান খান ও তাহিরুল কাদিরি গত ১৪ আগস্ট লাহোর থেকে রাজধানী ইসলামাবাদের উদ্দেশে তাদের আজাদি মার্চ শুরু করেন। ইতোমধ্যে পাকিস্তান সংসদের প্রধান বিরোধী দল পিপিপিসহ সব দল ইমরান খানের রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টির নিন্দা জানিয়েছে এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করে গণতন্ত্র ও সংবিধানকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়েছে।
নতুন করে তৈরি করা এই সঙ্কটের মাধ্যমে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা কি আবার বিপন্ন হতে চলেছে? দেশটির সামরিক বাহিনী কি গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক ঠুকে দিয়ে থাইল্যান্ডের মতোই দেশটির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসবে?
১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস থেকে দেশবাসীর দৃষ্টি ইমরান খান ও তাহিরুল কাদিরির লংমার্চ ও আন্দোলনের দিকে নিবদ্ধ রয়েছে। দাবি আদায়ে ইমরান খান অসহযোগ আন্দোলনেরও ঘোষণা দেন। ইমরান খান সংসদ থেকে পদত্যাগ ছাড়াও তিনটি প্রাদেশিক পরিষদ থেকেও পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। শুধু খাইবার পাখতুন খাওয়া প্রদেশে ইমরানের দল পিটিআই ক্ষমতায় রয়েছে।
২০১৩ সালে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে পাকিস্তান মুসলিম লিগ নওয়াজ (পিএমএল-এন)। এই নির্বাচনেই প্রথমবারের মতো বড় ধরনের সাফল্য পায় ইমরানের দল পিটিআই।
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে মোট আসনসংখ্যা ৩৪২। এর মধ্যে সরাসরি নির্বাচন হয় ২৭২টি আসনে। বাকি ৭০টি আসন নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ১৭২টি আসন। গত বছরের মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) ১৬৬, পাকিস্তান পিপলস পার্টি ৪৫ এবং ইমরানের পিটিআই ৩৪টি আসন পায়। পিটিআই জাতীয় পরিষদে তৃতীয় বৃহত্তম দলের মর্যাদা পাওয়ার পাশাপাশি খাইবার পাখতুন খাওয়া প্রদেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু এই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ইমরান খান। পিটিআইয়ের দাবিগুলো হচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ ও তার ভাই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের পদত্যাগ, নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, ভোট জালিয়াতির সাথে জড়িতদের শাস্তি এবং নতুন করে নির্বাচন। ইমরানের সমর্থকেরা ১৯ আগস্ট রাজধানীর সর্বোচ্চ সুরক্ষিত অঞ্চল রেড জোনে ঢুকে পড়ে। রেড জোনে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দফতর, পার্লামেন্ট ভবন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। উ™ভূূত পরিস্থিতিতে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিসার আলী খান ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নওয়াজের ভাই শাহবাজ শরিফ সেনাপ্রধান জেনারেল রাহেল শরিফের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেনাবাহিনী আলাপ-আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে সঙ্কট সমাধানের আহ্বান জানায়। সরকারের পক্ষ থেকে ইমরান খানকে আলোচনায় বসার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের আমির সিরাজুল হক উভয়ের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নেন। তবে পিটিআই একবার আলোচনায় বসলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি এবং পরে আলোচনায় বসার ব্যাপারে গড়িমসি করে। ইমরান খানের সাথে তাহির উল কাদরির পাকিস্তান আওয়ামি তাহরিক (পিএটি) ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক দল নেই। এমনকি সমমনা বলে পরিচিত পিএমএলকিউ (চৌধুরী সুজাত) আওয়ামি মুসলিম লিগ, মজলিশ ওয়াহদাতুল মুসলিমিন (রাজা নাসির আব্বাস) ও সুন্নি ইত্তেহাদের (সাহেব জাদা হামিদ রাজা) মতো দলও ইমরানের আন্দোলনের ব্যাপারে খুশি নয় তারা ইমরানের আন্দোলন সফল হওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান। জাতীয় পরিষদে গত ২১ আগস্ট প্রধান বিরোধী দল পিপিপির উত্থাপিত একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। ওই প্রস্তাবে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করার দাবি অসাংবিধানিক। পিপিপি নওয়াজের পদত্যাগের দাবির সাথে একমত নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে। এ দিকে পিপিপির কো-চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, গণতন্ত্রে অসহযোগ আন্দোলনের কোনো স্থান নেই। এর ফলে গণতন্ত্র ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।এ দিকে নওয়াজ শরিফ ইমরান ও তাহিরুল কাদরির দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন তিনি পদত্যাগ করবেন না। ইমরানের দল ছাড়া পার্লামেন্টের অন্যান্য দল সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে বলে উল্লেখ করে নওয়াজ শরিফ বলেন, যারা ১০-১২ হাজার মানুষকে পার্লামেন্টের বাইরে সমবেত করে অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে আমাকে ব্লেকমেইল করতে চান তাদের দাবির কাছে আমি নতি স্বীকার করব না।রাজনৈতিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ প্রেসিডেন্ট মামনুন হোসাইনের সাথে বৈঠক করেছেন।প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিকভাবে সঙ্কট সমাধানের ওপর জোর দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রেসিডেন্টের অনুমোদন নেন বলে জানা যায়। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে নওয়াজ শরিফের সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছে, পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আছে। পাকিস্তানে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর গ্রহণযোগ্য হবে না।্িবখ্যাত পশ্চিমা সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট তাদের এক বিশ্লেষণে বলেছে, সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খানের কাছে ক্রিকেটীয় রূপক খুবই প্রিয়। তাই তিনি গত কয়েক দিনে ক্রিকেট খেলার রেফারেন্স টেনে অনেক বক্তব্য দিয়েছেন।দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ক্রিকেট খেলা ও রাজনীতির মাঝের যে রূপক তাতে তার নিজস্ব একটা বড় ভূমিকা থাকার কারণে আম্পায়ারের প্রতি ইমরানের যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধার ঘাটতি রয়েছে বলতেই হবে। গত বছরের নির্বাচনে সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়ে পিটিআই নেতা ইমরান নির্বাচনী ফল পাল্টে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এ জন্য তিনি নির্বাচনকে ব্যাপক ম্যাক্স-ফ্রিক্সিংয়ের নির্বাচন বলে অভিযোগ করে মামলাও করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীন পর্যবেক্ষকেরা এ মামলায় সমর্থন দেননি। অপ্রতিরোধ্য ইমরান খান গত এক সপ্তাহ ধরে লাহোর থেকে ইসলামাবাদ অভিমুখে তার কর্মী-সমর্থকদের বহরকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে এনেছেন। তবে পাকিস্তানের অনেক বিশ্লেষকই ইমরান খানের সমর্থকসংখ্যা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তারা পুরো ব্যাপারটাকে ফপ বলেছেন। কারণ, ইমরান খান আগে বলেছিলেন যে, তিনি ১০ লাখ কর্মী-সমর্থক নিয়ে বিক্ষোভ আন্দোলন করবেন; কিন্তু তিনি মুষ্টিমেয় কিছু সমর্থক নিয়ে হাজির হয়েছেন। ইমরান সমর্থকেরা যখন মওসুমি বৃষ্টিপাতের মতো ইসলামাবাদের দিকে আসতে থাকেন, তখন দেখা গেলো তার সমর্থকসংখ্যা বড় জোর ২০ হাজার হতে পারে। ইমরান খান যে চরম দাবি করে বলেছেন (প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ) তা থেকে তিনি যাতে সরে আসতে পারেন, তাতে সহায়তা করতে দৃশ্যত শরিফও তেমন আগ্রহী নন। যদিও ইমরানের ইচ্ছা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তবুও এই অচলাবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী সুযোগ পেয়ে যায় এবং তাদের প্রথামতো ভূমিকাকে (দেশ পরিচালনায় হস্তক্ষেপ) আরো সংহত করেছে।ক্ষমতার প্রথম বছরে নওয়াজ সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকে হ্রাস করতে চেয়েছিলেন। যদিও সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে নীরব আছে, তবে সব স্টেক হোল্ডারদের ‘সংযত’ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, নওয়াজ শরিফের পতনের পুরো নাটকটাই নীরবে মঞ্চায়ন করতে চাইছেন জেনারেলরা। সেই পাতানো ম্যাচের অধিনায়ক হচ্ছেন ইমরান খান।রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, কাদরির ইনকিলাব মার্চ ও ইমরান খানের আজাদি মার্চের কারণে পাকিস্তানে গভীর রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এই কারণে নওয়াজ সেনাপ্রধানের কাছে দূত পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন।সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, দূতরা সুসংবাদ ও দুঃসংবাদ দুই-ই এনেছেন। সামরিক বাহিনী অভ্যুথান ঘটাবে না বলে প্রধানমন্ত্রীকে যেমন আশ্বস্ত করা হয়েছে, তেমনি আবার ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইলে সামরিক বাহিনীর জন্য ছাড় দিতে হবে বলেও জানিয়ে দিয়েছে। সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র আসিমবাজ ওয়া এক বার্তায় ‘অর্থপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে সঙ্কট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনীর সমর্থক না পেয়ে ইমরান ও কাদরির বিক্ষোভ ব্যর্থ হলেও পাকিস্তানে নওয়াজের সরকার ভবিষ্যতে দুর্বল হয়ে পড়বে।সাবেক সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফকে বিচারের মুখোমুখি করা, তালেবানদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে সিদ্ধান্তহীনতা, ভারতের সাথে সম্পর্ক জোরদারের নীতিসহ কয়েকটি কারণে দেশটির শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা নওয়াজের ওপর নাখোশ।বিষয়টি নওয়াজও জানেন। তাই চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটকে পুঁজি করে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ দিকে বিশ্বব্যাপী সঙ্ঘাত প্রতিরোধে কাজ করা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) পাকিস্তানে সেনা হস্তক্ষেপের আশঙ্কা বেড়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আইসিজি বলেছে, গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বকে সাংবিধানিক আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা ও অর্থবহ করতে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। পাকিস্তানি একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, হয় সামরিক বাহিনী নওয়াজকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য ইমরানকে সাহস দিয়েছে, নয়তো সামরিক নেতাদের মনোভাব বুঝতে পেরে ইমরান নিজেই সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছেন। ওই বিশ্লেষক আরো বলেন, নওয়াজের সাথে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক শূন্যের কোঠায় না পৌঁছে থাকলে আজাদি মার্চ থেকে ফায়দা হাসিল করতে পারবেন না ইমরান।আসলেই পাকিস্তানে শেষ পর্যন্ত কী ঘটতে যাচ্ছে। এক দিকে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার প্রয়াস, অপর দিকে ফৌজি শাসন ফিরিয়ে এনে দেশটিকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র। একবিংশ শতাব্দীতে এসে পাকিস্তানে কি আইয়ুব, ইয়াহিয়া, জিয়াউল হক ও পারভেজ মোশাররফের পথ ধরে আবার কোনো সেনাশাসক আসবেন? নাকি একটি গণতান্ত্রিক সরকার পূর্ণ পাঁচ বছর দেশ শাসন করে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের উত্তরসূরিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রায় দেড় বছরের মাথায় আবার ফৌজি শাসনে ফিরে যাবে? অবশ্য মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার পর ইমরান খান এখন অনেকটা কোণঠাসা। সেনাবাহিনীও ক্ষমতা নিলে এখন দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হবে। তাই ইমরান খান ও সেনা বাহিনীর উচ্চাভিলাষ পূরণ হওয়া খুব সহজ বলেও মনে হচ্ছে না। পিটিআইর এমপিদের পদত্যাগপত্র এখনো গৃহীত হয়নি। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে সাথে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রেখে সঙ্কট সমাধানই পাকিস্তানের জন্য কল্যাণকর হবে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে।