শুভ্র মেঘের চাদরের নিচে সবুজ বনরাজিতে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি
মোঃ জাফর ইকবাল, ঢাকা : পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে নয়নাভিরাম দৃশ্য, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবনধারা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। চারপাশে বিছিয়ে রাখা শুভ্র মেঘের চাদরের নিচে রয়েছে সবুজ বনরাজিতে ঘেরা ঢেউ খেলানো অসংখ্য ছোট-বড় পাহাড়। তার মাঝ দিয়ে চলে গেছে আঁকা-বাঁকা সড়ক, পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলেছে নদ-নদী ও ঝর্ণাধারা।
টানা ছুটিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঝর্ণার শীতলতায় গা ভাসাতে অনেকে ছুটে আসছেন খাগড়াছড়ি। হোটেল-মোটেল আগাম বুকিং হয়ে গেছে। যারা আগাম হোটেল বুকিং না দিয়ে আসছেন তাদের ভালোই বিড়ম্বনায় পড়তে হবে। আসুন এক নজরে জেনে নেওয়া যাক খগড়াছড়িতে বেড়ানোর স্থানগুলো-
ছবি (মোঃ জাফর ইকবাল)
আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র : খাগড়াছড়ি শহরের প্রবেশ পথে পড়বে আলুটিলা। জেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্র। প্রায় হাজার ফুট উঁচু এ ভূ-নন্দন বিন্দুটি বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্পট। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়নবোর্ডের উদ্যোগে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রে দর্শনার্থীদের বসার জন্য পাকা বেঞ্চ, বিশ্রামের জন্য পাকা ছাউনি, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার করা হয়েছে। টিলার মাথায় দাঁড়ালে শহর, চেঙ্গী নদীর প্রবাহ ও মেঘের কারুকাজ মনকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে তোলে। চোখে পড়ে ঢেউ তোলা সবুজ পাহাড়ের বুকে সর্পিল রাস্তা। জুম চাষীদের ছোট ছোট মাচাং ঘর। সড়ক ও জনপথ বিভাগের চমৎকার ডাক বাংলো রয়েছে এখানে।
আলুটিলার রহস্যময় গুহা : গা ছমছম করা অনুভূতি নিয়ে পাহাড়ি সুড়ঙ্গ পথ বেয়ে পাতালে নামার কল্পনা আলুটিলায় বাস্তব রূপ নেয়। এখানে রয়েছে বিখ্যাত একটি গুহা ও সুড়ঙ্গ। পাহাড়ি পিচ্ছিল পথ বেয়ে গুহার মুখ পর্যন্ত যেতে দর্শনার্থীদের এক সময় কষ্ট হলেও এখন জেলা পরিষদের অর্থায়নে পাকা সিঁড়ি করে দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ের চূড়া থেকে ২৬৬টি সিঁড়ি বেয়ে নামলেই গুহামুখ। সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮২ ফুট। মশাল নিয়ে ঢুকতে হয়। গুহার সৌন্দর্য ও হাজার হজার বাদুড় ঝুলে থাকার দৃশ্যও চোখে পড়ার মতো। পাহাড় কেটে নিপুণ কারিগররা যেন নিখুঁত এ গুহাটি তৈরি করেছে। অন্য প্রান্ত দিয়ে বের হয়ে হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজেকে ভাবতে পারেন দুঃসাহসিক অভিযাত্রী।
রিছাং ঝর্ণা : আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র থেকে কিছুটা দূরেই রিছাং ঝর্ণা। শিরশির ছন্দে হিম শীতল ঝর্ণার বহমান স্বচ্ছ পানি যে কাউকেই কাছে টানবে। এর জন্য মূল সড়ক থেকে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে। মাটিরাঙ্গা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রবেশ মুখে একটি গেটসহ পর্যটকদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কটি গোল ঘর। নিরাপত্তার জন্য বসানো হয়েছে পুলিশ পাহারা। আর কিছু উন্নয়ন প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়েছে।
ছবি (মোঃ জাফর ইকবাল)
হাজাছড়া ঝর্ণা : দীঘিনালা-বাঘাইহাট সড়ক থেকে মাত্র ১শ’ গজ ভিতরে হাজাছড়া ঝর্ণা। হাজাছড়া আবিষ্কার হয় ২০১১ সালে। যারা সাজেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে যাবেন, ফেরার পথে হাজাছড়া ঝর্ণার শীতল পানির ছোঁয়া নিতে ভুলবেন না।
তোয়ারি মাইরাং : ত্রিপুরা শব্দ তোয়ারি মাইরাংয়ের বাংলা অর্থ পানির কূপ। ঝর্ণাটি দীঘিনালা বোয়ালখালীতে অবস্থিত। খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কের ভৈরফা ব্রিজ থেকে কিছুটা ভেতরে গেলে ঝর্ণাটির দেখা মিলবে।
কাশিং তৈ কলাই ঝর্ণা : ‘কাশিং তৈ কলাই’ এর অর্থ কচ্ছপ পড়ে। স্থানীয় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মতে, এক সময় এ ঝর্ণার পানির সঙ্গে কচ্ছপ পড়ত। সে থেকে এর নাম ‘কাশিং তৈ কলাই’। এটি দীঘিনালা উপজেলার সীমানা পাড়ায় অবস্থিত। খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়ক থেকে মাত্র আধা কিলোমিটারের পথ।
দুই মুড়া ঝর্ণা : দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নে অবস্থিত। সড়ক ও পায়ে হাটা পথ মিলে ৫ কিলোমিটার।
দেবতা পুকুর : জেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি সড়কের কোল ঘেঁষে মাইসছড়ির নুনছড়ি মৌজার আলুটিলা পর্বতশ্রেণী হতে সৃষ্ট ছোট্ট নদী নুনছড়ি। নুনছড়ির সমতল ভূমি হতে প্রায় ৭শ’ ফুট উপরে পাহাড়ের চূড়ায় দেবতা পুকুর। ৫ একর আয়তনের পুকুরটির স্বচ্ছ জলরাশি পর্যটকদের উদাসীন করে তোলে। পুকুরের চারিদিকে ঘন সবুজ বনরাজি। কথিত আছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের জলতৃষ্ণা নিবারণের জন্য জলদেবতা পুকুরটি খনন করেন। পুকুরের পানিকে স্থানীয় পাহাড়িরা দেবতার আশীর্বাদ বলে মনে করেন। প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে অজস্র নারী-পুরুষ পূন্য লাভের আশায় দেবতা পুকুর দর্শনে আসেন।
হেরিটেজ পার্ক : চেঙ্গী নদীর কোলে জেলা আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত হেরিটেজ পার্ক ইতিমধ্যে পর্যটন কেন্দ্রের তালিকায় নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। পর্যটন মোটেলের বিপরীতে নান্দনিক হেরিটেজ পার্কটির অবস্থান। এখানকার প্রকৃতি যেন ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যায় বসে রঙের মেলা। আর পাহাড় ঘেরা প্রকৃতি চাঁদনী রাতের দৃশ্যপটে এনে দেয় ভিন্ন মাত্রা। ১০ একর ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হেরিটেজ পার্কে সংবাদকর্মীদের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ‘মিডিয়া সেন্টার’।
ভগবান টিলা : মাটিরাঙ্গা উপজেলা থেকে সোজা উত্তরে ভারতের সীমান্তবর্তী ভগবান টিলা। জেলা সদর থেকে উত্তর পশ্চিমে এর কৌণিক দূরত্ব আনুমানিক ৮৫ কিলোমিটার। সবুজের বুক চিরে আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে বিস্ময় বাড়তে থাকবে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক হাজার ছয়শ’ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এ টিলা সম্পর্কে স্থানীয়দের ধারণা, এ টিলার উপরে দাঁড়িয়ে ডাক দিলে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা শুনতে পান। আর এ কারণেই এ টিলার নামকরণ ভগবান টিলা। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর একটি আউট পোস্ট রয়েছে এখানে।
রামগড় চা বাগান : রামগড় সীমান্ত ঘেঁষে জেলায় প্রবশের সম্মুখভাগে খাগড়াছড়ি-ফেনী আঞ্চলিক মহাসড়কের-সড়কের দুইধারে চোখ জুড়ানো চা বাগান। যা খাগড়াছড়ির পর্যটনকে করেছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যেন ভ্রমণপিপাসুদের স্বাগত জানাতে সদা প্রস্তুত সবুজ গালিচা।
রামগড় লেক : জেলা সদর হতে ৫০ কিমি উত্তর-পশ্চিমে খাগড়াছড়ির প্রবেশদ্বার রামগড় উপজেলা। উপজেলা পরিষদের সামনে ইংরেজি অর ডব্লিউয়ের অনুরূপ প্রায় ২৫০ মিটার লম্বা একটি হ্রদ। এতে রয়েছে ছোট-বড় বেশ কটি প্রমোদ তরী। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের পরিকল্পনায় গড়ে তোলা রামগড় পর্যটন লেকটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন। চারপাশ বাঁধানো লেকটি রেলিং ঘেরা ও বাহারি সাজে সজ্জিত। মাঝখানে রয়েছে সুদৃশ্য ঝুলন্ত সেতু। রয়েছে সুন্দর বাগান, সবুজ ঘাস, আধুনিক লাইটিং, শান বাঁধানো সিঁড়ি। দুই তীরের উদ্যানে রয়েছে দেশি-বিদেশি গাছপালা। দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য রয়েছে ১২টি শেড। এ ছাড়া স্মৃতিস্তম্ভ, শহীদ মিনার ভ্রমণের আনন্দ বাড়িয়ে দেবে।
মানিকছড়ি রাজবাড়ী : খাগড়াছড়ি-ঢাকা সড়ক হয়ে জেলার প্রবেশমুখ মানিকছড়ি উপজেলা সদরে রয়েছে মানিকছড়ি রাজবাড়ী। রাজবাড়ীতে রয়েছে মংসার্কেল চিফ (মংরাজা) এর রাজত্বকালীন স্থাপত্য। রাজার সিংহাসন, মূল্যবান অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রত্নতাত্ত্বিক অনেক স্মৃতি বিজড়িত এ রাজবাড়ী।
শতায়ু বটগাছ : মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদরের খুব কাছাকাছি আলুটিলা-বটতলী এলাকায় এ শতবর্ষী বটবৃক্ষটি ইতিহাসের সাক্ষী। ৫ একরের অধিক ভূমির উপরে এ গাছটি হাজারো পর্যটক দারুণ আকর্ষণ করে। মূল বটগাছটি থেকে নেমে আসা ডালপালা ও ঝুরি মাটিতে মিশে এক একটি নতুন বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। বটগাছটিকে ঘিরে আছে নানা কাহিনী। যেমন এটি রোগমুক্তির প্রতীক। মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিমি উত্তরে অবস্থিত এ বটবৃক্ষের নামানুসারেই গড়ে উঠেছে বটতলী বাজার। গাছটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে স্কুল, মাদ্রাসা ও বাজার।
শিবছড়ি পাহাড় : দীঘিনালা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৬ কিমি দূরে দেওয়ানপাড়ায় অবস্থিত শিবছড়ি পাহাড়। পাহাড়ী ছড়া, নালা ও গভীর অরণ্য পেরিয়ে বোয়ালখালী নদীর পাশ ঘেঁষে সুউচ্চ পাহাড়ি ঝর্ণা ও সৌন্দর্য্যমণ্ডিত পাথরের রূপ পর্যটকদের আকৃষ্ট করবেই।
কিভাবে আসবেন : ঢাকা হতে খাগড়াছড়ির দূরত্ব ৩১৬ কিমি ও চট্টগ্রাম হতে ১০৯ কিমি। ঢাকার কমলাপুর, সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, কলাবাগান থেকে সরাসরি বাস রয়েছে খাগড়াছড়িতে। উপকূল সেন্টমার্টিনের এসি বাস, এস আলম, সৌদিয়া, শান্তি পরিবহন, ঈগল ও শ্যামলী পরিবহনের যে কোনো একটি বেছে নিতে পারেন। নন-এসিতে গুণতে হবে ৫০০-৫৫০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে আসতে হলে অক্সিজেন অথবা কদমতলী বিআরটিসি বাস টার্মিনাল যেতে হবে। অক্সিজেন থেকে রয়েছে শান্তি পরিবহন ও লোকাল বাস এবং কদমতলী থেকে বিআরটিসি। চট্টগ্রাম থেকে আসতে ১৮০-২২০ টাকা গুণতে হবে।
কোথায় থাকবেন : শহরের প্রবেশমুখে চেঙ্গী নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত পর্যটন মোটেলের ডবল রুম নন-এসি ১০৫০ টাকা, ডবল এসি রুম ১৫০০ টাকা, ভিআইপি স্যুইট ২৫০০ টাকা। এ ছাড়াও রয়েছে জেলা সদরের মিলনপুরে হোটেল গাইরিং ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় হোটেল ইকোছড়ি ইন। সেখানে থাকা-খাওয়ার সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। খাগড়াছড়ি বাজার এলাকার হোটেল আল-মাসুদ, হোটেল লবিয়ত, হোটেল ফোর স্টারসহ অনেকগুলো হোটেলে থাকতে পারবেন সুলভে। খাগড়াছড়ি পর্যটক মোটেলের ব্যবস্থাপক অলক চাকমা জানান, পর্যটকের সংখ্যা বিগত দিনের চেয়ে বেড়েছে। পর্যটন মোটেলের সকল রুম ২৮ জুলাই থেকে এক সাপ্তাহের জন্য আগাম বুকিং হয়ে গেছে। একই তথ্য দিয়েছেন হোটেল গাইরিংয়ের ব্যবস্থাপক এস অনন্ত ত্রিপুরা।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার শেখ মো. মিজানুর রহমান জানান, পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় তিন পোশাকধারীর পাশাপাশি ডিবি ও সাদা পোশাকে পুলিশ সর্বদা প্রস্তুত রয়েছেন। কোনো পর্যটক পুলিশ চাইলে তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে।