যে কারণে জীবন দিতে হলো মাওলানা ফারুকীকে
রোকন উদ্দিনঃ পবিত্র কোরআন মাজীদের প্রথম সূরা হচ্ছে সূরাতুল ফাতিহা। অনেকে এটিকে আলহামদুলিল্লাহ সূরা বলে। এই সূরাখানার সাথে পরিচিতি নাই বা এই সূরা মুখস্থ নাই এমন মুসলমান বোধ হয় বিশ্বে খুব কমই আছে। হয়তো এ সূরার অর্থ বা ভাবার্থ সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা না থাকতে পারে।
এ সূরার ৫ম ও ৬ষ্ঠ আয়াতখানা হচ্ছে ‘‘ইহ্দিনাস সিরাত্বাল মুসতাক্বীম, সিরাত্বাল লাযিনা আনআমতা আলাইহিম।’’ এ আয়াত দু খানার মধ্যে প্রথম আয়াতের অর্থ বা ভাবার্থ হচ্ছে ‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে সহজ-সরল-সঠিক পথে পরিচালিত করুন।’ পরের আয়াতে আল্লাহ ‘সিরাতুল মুসতাক্বীম’ তথা সহজ-সরল-সঠিক পথ কোন্টি তা বলে দিচ্ছেন এভাবে যে, ‘সিরাতুল মুসতাক্বীম ওই পথ, যে পথ ও মতের উপর আমার (আল্লাহর) অনুগ্রহপ্রাপ্ত বান্দাগণ রয়েছেন।’
অর্থাৎ আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত বান্দাগণের মত ও পথই হচ্ছে ‘সিরাতুল মুসতাক্বীম।’ এখন প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন জাগে ‘আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত’ বান্দাগণ কারা। এঁদের পরিচয়ও আল্লাহ কোরআন পাকে অন্য এক সূরায় দিয়ে দিয়েছে এভাবে যে, ‘‘উলাইকাল্লাযিনা আনআমাল্লাহু আলাইহিম মিনান্ নাবিয়্যিনা, ওয়া সিদ্দিক্বীনা, ওয়াশ শুহাদায়ে, ওয়াস্সালেহীনা ওয়া হাসুনা উলাইকা রাফীক্বা।’’ এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘‘আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত মহান বান্দাগণ হচ্ছেন : নবীগণ, সিদ্দিক্বীন তথা সত্যবাদীগণ, শহীদগণ এবং সৎকর্মশীল ব্যক্তি তথা আউলিয়া কেরাম।
আর এঁরাই হচ্ছেন আল্লাহর উত্তম বন্ধু।’’ মহান রাব্বুল আলামীন নিজেই সার্টিফাই করে দিলেন কোন্ কোন্ শ্রেণীর বান্দাগণ আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত, কাদের উপর আল্লাহ রাজি এবং খুশি। সুতরাং এঁদের পথই হচ্ছে সিরাতুল মুসতাক্বীম তথা সহজ-সরল-সঠিক পথ, যে পথে আমাদেরকে পরিচালিত করতে আমরা মাবুদের কাছে প্রার্থনা করি।
এখন আসা যাক আলোচ্য বিষয়ের উপর। আমি ভূমিকায় যে কথাগুলো অবতারণা করলাম তা আমার আলোচ্য বিষয়ের সাথে শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, মূল ভিত্তিই বটে। উল্লেখিত আয়াতে কারীমায় আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত বান্দা হিসেবে যে ক’ শ্রেণীর মহান বান্দাগণের পরিচয় জানলাম তার মধ্যে তৃতীয় স্তরের হচ্ছেন শহীদগণ। অর্থাৎ ঈমান এবং ইসলামের জন্য, শুধুমাত্র আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলকে ভালোবাসার নিমিত্তে যিনি বা যাঁরা শাহাদাত বরণ করেছেন।
সে শাহাদাতের কাফেলা ইসলামের প্রথম যুগ তথা হুজুর (দঃ)-এর সময় থেকেই চলে আসছে। আর সাইয়্যেদুস শুহাদা বলা হয় নবীজীর চাচা হযরত আমীর হামজা (রাঃ)কে। সেই শাহাদাতের পথ বেয়ে ৬১ হিজরী সনের মহররম মাসের ১০ তারিখে কারবালার প্রান্তরে ইমাম আলী মাক্বাম নবী রাহমাতুল্লিল আলামীন (দঃ)-এর কলিজার টুকরা ইমাম হোসাইন (রাঃ)সহ ৭২ জন ইমাম পরিবার তথা আওলাদে রাসূল শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছেন। এ ৭২ জন আওলাদে রাসূলের শাহাদাতের বিনিময়ে কেয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে দ্বীন ইসলাম কায়েম থাকবে।
এটাই আল্লাহর বিধান। আল্লাহর হাবীব (দঃ)-এর আওলাদে পাকের পবিত্র রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীতে ইসলাম আজো স্বমহিমায় টিকে আছে, কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। কারবালার শাহাদাতের ধারাবাহিকতা যুগ যুগ ধরে থাকবে। তাই তো আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হায়, হার কারবালা কী বা’দ।’ যুগে যুগে মৃতপ্রায় ইসলাম আবার স্বমহিমায় জিন্দা হবে একেকটি কারবালা সংঘটিত হওয়ার পর।
সে শহীদী কাফেলার ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নাম লিখালেন আল্লামা শায়খ নূরুল ইসলাম ফারুকী (রঃ)। তাঁর এ শাহাদাত স্রেফ ইসলামের জন্য। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে তিনি টিভি মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলামের সঠিক মূলধারার যে বিষয়গুলো বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন, অসংখ্য মানুষকে নবী প্রেমিক, অলিপ্রেমিক বানিয়েছেন এটাই তাঁর শাহাদাতের মূল কারণ।
এ বিষয়টি পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়, মওদুদীবাদী, খারেজী (কওমী), ওহাবী-নজদীবাদী, আহলে হাদিস ও সালাফীসহ ভ্রান্ত মতাবলম্বীরা বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে, বিভিন্ন টিভিতে ইসলামী অনুষ্ঠানে ইসলাম এবং কোরআন-হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মুসলমানদের যে ঈমান-আক্বীদা নষ্ট করতেন, সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াতেন, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও দলাদলি সৃষ্টি করতেন তার বিরুদ্ধে আল্লামা নূরুল ইসলাম ফারুকী সোচ্চার ছিলেন।
তিনি আপোষহীনভাবে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলসহ চ্যানেল আই, মাই টিভি, বিটিভিসহ বিভিন্ন টিভি মিডিয়ায় কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসকে সামনে রেখে ওইসব ভ্রান্ত মতবাদীদের বক্তব্য এবং মতামতকে ভুল ও কোরআন হাদিসের অপব্যাখ্যা বলে প্রমাণ করতেন। তিনি তাদের প্রতি প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতেন।
তিনি লাখ টাকা পুরস্কারের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলতেন, টিভির পর্দায় বসে এভাবে কোরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা করে মুসলমানদের ঈমান-আকীদা ধ্বংস এবং সমাজে ফেৎনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি না করে আসুন আমরা কোরআন এবং হাদীস নিয়ে বসি। যা সঠিক তা মেনে নেই। মর্দে মুজাহিদের মতো তাঁর এ চ্যালেঞ্জকে তারা গ্রহণ না করে তাঁকে তারা হত্যার পথ বেছে নিলো। তারা সিদ্ধান্ত নিলো ফারুকীকে মেরে ফেলে মিডিয়া জগত থেকে সুন্নী মতাদর্শের তথা সুফীজমের আলোচনা চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে।
কিন্তু ওই নরাধমদের ইসলামের শহীদী কাফেলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জানা নেই। ইমাম হোসাইন (রাঃ)সহ ৭২ জন আওলাদে রাসূলের শাহাদাতের বিনিময়ে কেয়ামত পর্যন্ত ইসলাম সমহীমায় উদ্ভাসিত থাকবে। তেমনি আল্লামা ফারুকী (রঃ)-এর শাহাদাতের রক্তের বিনিময়ে এদেশে ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আদর্শ বাস্তবায়িত হবে ইনশাআল্লাহ। এ দেশের কোটি কোটি নবী প্রেমিক অলি প্রেমিক সুন্নী মুসলমানদের ঈমানের দৃঢ়তা তাই এবং সান্ত্বনাও এখানে।
এখন হয়তো কেউ প্রশ্ন করতে পারেন মওদুদীবাদী, ওহাবী, কওমী, আহলে হাদিস যাদেরকে বলা হচ্ছে তারাও তো মুসলমান এবং আলেম (নামধারী)। তাহলে মুসলমান হয়ে বা আলেম সম্প্রদায় হয়ে কীভাবে ভিন্ন মতের আরেকজন স্বনামধন্য আলেমকে জবাই করে হত্যা করতে পারে? তাও কি সম্ভব? সে ভাইদেরকে আমি কারবালার ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
ইমাম হোসাইন (রাঃ)সহ ৭২ জন আওলাদে রাসূলকে যারা শহীদ করেছে তারাও মুসলমান ছিলো, শুধু মুসলমানই নয়, তারা পাক্কা মুসল্লিও ছিলো। এজিদ বাহিনী ইমাম হোসাইন (রাঃ)’র বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেও যুদ্ধের ময়দানে এজিদ বাহিনী নামাজ ত্যাগ করেনি। এমনকি ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর মস্তক মোবারক দেহ থেকে আলাদা করার পর তারা উল্লসিত হয়ে আজান, ইকামত এবং জামাতের সাথে আছরের নামাজ আদায় করেছে। ইতিহাস তা-ই বলে।
বিজ্ঞ পাঠক, শরীরের লোম শিউরে উঠে। এই নরাধম খুনি এজিদ বাহিনীকেও কি মুসলমান বলা যাবে? এ সমস্ত মুসল্লি তথা নামাজীদের জন্যই তো আল্লাহ বলেছে ‘ফাওয়াইলুললিল মুসাল্লিন।’’ অর্থাৎ এ সমস্ত নামাজী মুসল্লিদের জন্যই তো ‘ওয়াইল’ নামক জাহান্নাম নির্ধারিত। সে এজিদের উত্তরসূরি তো এখনো আছে, যুগ যুগ ধরে থাকবে। তাছাড়া নবীজীর পেছনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করেছে, নবীজীর সাথে ধর্মীয় যুদ্ধে অংশ নিয়েছে এমন বাহ্যিক পাক্কা মুসলমানকেও তো আল্লাহ কোরআন পাকে মোনাফেক বলে সম্বোধন করেছেন।
আর এ মোনাফেকদের সর্দার তো আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুল। তার উত্তরসূরি তো এখনো আছে, কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। সুতরাং অবাক হবার কিছু নেই, বাহ্যিক মুসল্লি এবং নামধারী আলেমদের দ্বারা নূরুল ইসলাম ফারুকীর মতো মর্দে মুজাহিদ নবী প্রেমিক সুন্নী আলেমরা খুন হবে।
আল্লামা ফারুকী (রঃ) ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর ডাকে সাড়া দিয়ে শাহাদাতের পেয়ালা পান করে আমাদের জন্য কী ম্যাসেজ দিয়ে গেলেন সেটিই এখন আমাদের চিন্তা-চেতনা এবং বাস্তবে পরিণত করার বিষয়। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল (দঃ) আমাদের সহায় হোন। আমিন।