ঘুরে আসুন লালমাটির চূড়ায় কালীমন্দির
সালাম জুবায়েরঃ সমতল থেকে উচ্চতা প্রায় দুইশ’ ফুট। এতে অবশ্য ভক্তদের কোনো সমস্যাই হয় না। কারণ সেখানে যাওয়ার জন্য টিলা কেটে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। এর আগে পথের দুই পাশে সারি সারি চা বাগান আপনাকে মুগ্ধ করবে। সেই বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে এসে আপনি যখন পাহাড়ি টিলার মাঝখান দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকবেন তখন অন্যরকম এক অনুভূতি হবে। এভাবেই ২ কি.মি. পথ পায়ে হেঁটে পৌঁছতে হবে টিলার চূড়ায়। আর সেখানেই কালীমন্দিরে ভক্তের অপেক্ষায় আছেন দেবী স্বয়ং।
কালীমন্দিরের উদ্দেশে চূড়ায় উঠতে হলে অবশ্য আপনাকে একটু সতর্ক হতে হবে। পা পিছলে গেলেই বিপদের আশঙ্কা। অবশ্য সেই আশঙ্কা কেটে গিয়ে মুহূর্তেই মন জুড়িয়ে যাবে টিলায় ওঠার পর চারদিকের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে। টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে মনে হবে দিগন্তে মিশে গেছে সুনীল আকাশ। সে এক অপরূপ দৃশ্য!
পাশের দেশ ভারত থেকে কালীমন্দির দর্শনে এসেছেন তরুণকুমার আইচ সপরিবারে। কথাপ্রসঙ্গে তিনি জানালেন, টিলার সৌন্দর্য এবং লালমাটি দেখে তার খুব ভালো লেগেছে। বিশেষ করে তার কন্যা ত্রিশিতা আইচের ঘোর যেন কাটছেই না। ও এমন লালমাটি আগে দেখেনি। যদিও বহু দেশ তারা ঘুরেছেন।
ঢাকা থেকে লালমাটির টিলা ও মন্দির দেখতে এসেছেন সুজিত পাল। তিনিও সপরিবারে এসেছেন। সুজিত পাল জানালেন, তিনি বহুবার এখানে এসেছেন। যতবার এসেছেন ততবারই ভালো লাগার আবেশে মুগ্ধ হয়েছেন। তাই এবার স্ত্রী-সন্তান সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। তবে মুগ্ধতার পাশাপাশি তার কণ্ঠে বিরক্তিও ফুটে উঠল। তিনি বললেন, মন্দিরের আশেপাশে পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। অনেক সময় এতো উপরে ওঠার পর পিপাসা লাগতে পারে। এ ছাড়া দর্শনার্থীদের জন্য কোনো শৌচাগার নেই। মন্দিরে সার্বক্ষনিক লোক রাখাও আবশ্যক। মন্দিরটি তালাবদ্ধ থাকায় সাধারণ দর্শনার্থীদের মন্দিরের বাইরে থেকেই মাকে দর্শন করে ফিরে যেতে হয়। যেহেতু এখানে প্রতিদিনই অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী আসেন সেহেতু মন্দিরে একজন সেবায়েত থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া সমতল থেকে কতটা চূড়ায় মন্দির, এটা অনেকে জানেন না। পর্যটকদের এ বিষয়গুলো জানানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। নতুবা হৃদরোগীদের সমস্যা হতে পারে।
গাজীপুরের টঙ্গী থেকে রিপন, শিপলু, অমিত-তিন বন্ধু এসেছেন লালমাটি টিলায়। টিলায় উঠে তারা ভীষণ উচ্ছ্বসিত। অমিত জানালেন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ঘুরতে এসে একজনের মুখে এ স্থানটির কথা শুনে দেখতে এসেছেন। এ স্থানটি তার কাছে স্বর্গোদ্যান মনে হচ্ছে। এতো সুন্দর একটি স্থান কেন অবহেলায় পড়ে রয়েছে সেটি নিয়ে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি মনে করেন এ স্থানটি মৌলভীবাজার জেলার অন্যতম সৌন্দর্যময় একটি পর্যটন স্পট হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে।
লালমাটি টিলার কালীমন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে ফুলছড়া চা বাগানের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রায় শতাধিক বছর পূর্বে লালমাটি টিলা ও টিলার আশেপাশে বাগানের শ্রমিক কলোনি ছিলো। সে সময় টিলার চূড়ায় দণ্ডকালী পূজা হতো। এক সময় চা-বাগান কর্তৃপক্ষ চা-শ্রমিকদের লালমাটি টিলা থেকে সমতল এলাকায় সরিয়ে নেয়। এরপর থেকে টিলা এলাকায় পূজা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ২০০০ সালে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একদল ছাত্রছাত্রী পিকনিক করতে আসে। পিকনিক শেষে তারা ফিরে যাবার সময় আকস্মিকভাবে তাদের গাড়ি টিলার পাশের খাদে প্রায় দুইশ’ ফুট নিচে পড়ে যায়। এ ঘটনায় গাড়ির চালক ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান। এ ঘটনার প্রায় ৬ বছর পর এক রাতে চা-বাগানের এক শ্রমিক স্বপ্নে দেখেন, কালীমন্দিরের সামনে দিয়ে এক লোক গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় গাড়িটি ঝিলের পানিতে পড়ে যাচ্ছে। ঠিক তখনই লম্বা গড়নের কালো এক মহিলা এসে গাড়িটি ঝিলের পানিতে নিমজ্জিত হবার হাত থেকে রক্ষা করেন। এই স্বপ্ন দেখার পর ওই চা-শ্রমিক ঘটনাটি বাগানের পঞ্চায়েতদের জানালে সবাই মিলে এখানে কালীমন্দির করার সিদ্ধান্ত নেন।
২০০৭ সালে কালীমন্দির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মন্দির নির্মাণের পর দেবীর মূর্তি তৈরির কাজ বিভিন্ন কারণে বন্ধ রাখা হয়েছিল। কিছুদিন পর মন্দিরে গিয়ে দেখা যায় একটি বিষধর সাপ অর্ধসমাপ্ত কালীমূর্তি পেঁচিয়ে ধরে আছে। বাগানবাসী অনেক চেষ্টা করেও সাপটি সেখান থেকে সরাতে পারেননি। তখন বাধ্য হয়েই এলাকায় কালী পূজা করা হয়। পূজার পর সাপটি সরে গেলে মন্দিরে কালীমূর্তি তৈরির কাজ দ্রুত শেষ করা হয়।
বর্তমানে ফুলছড়া চা-বাগানের লালমাটি টিলায় অবস্থিত কালীমন্দিরের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে প্রতিদিনই অসংখ্য ভক্ত এখানে ভিড় জমাচ্ছেন। কেউ কেউ এখানে মানত নিয়ে আসছেন মনোবাসনা পূর্ণ হবার লক্ষ্যে। প্রতি বছর চৈত্র মাসে মন্দিরে দণ্ডকালীর পূজা হয়। যদি কর্তৃপক্ষ লালমাটি টিলা ও কালীমন্দিরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তবে স্থানটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য হতে পারে জেলার অন্যতম দর্শনীয় পর্যটন স্পট। যেভাবে যাবেন : দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে ট্রেন, বাসযোগে আসতে হবে শ্রীমঙ্গল। শ্রীমঙ্গল পৌঁছে রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফরমের ঠিক উল্টো পাশে কালীঘাট সড়কে গিয়ে সেখান থেকে সিএনজি অটোরিক্সায় সহজেই পৌঁছে যাবেন ফুলছড়া চা বাগানের প্রবেশমুখে। সিএনজি অটোরিক্সায় ১০ মিনিট লাগবে। সেখান থেকে বামদিকের মেঠো পথ ধরে হেঁটে যেতে সময় লাগবে ৪৫ মিনিট। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪ কি.মি. দূরে অবস্থিত ফিনলে টি কোম্পানির ফুলছড়া চা বাগানের ৫ নম্বর সেকশনে কালীমন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছে।
ছবিঃ মোঃ জাফর ইকবাল