মালয়েশিয়ায় শ্রমিকদের ওর্য়াক পারমিট পাবার স্বপ্ন উবে যাচ্ছে
তুহিন মজুমদার, মালয়েশিয়া থেকে ফিরে : নানা অপরাধে মালয়েশিয়া কারাগারে এখন বন্দী হিসেবে সাজা কাটছেন প্রায় ৩৫০ জন বাংলাদেশি। আর বৈধ-অবৈধ এবং নানা কারনে সে দেশের পুলিশ ক্যাম্পে আটক আছেন অন্তত ১৭০০ জনেরও অধিক বাংলাদেশি। এর কারণ শ্রমিকদের ভিসার মেয়াদ চলে যাওয়াসহ অপরাধ প্রবনতা বেড়ে যাওয়া। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে কথা বলে সেখানে বসবাসরত শ্রমিকের সমস্যা, তাদের দাবি এবং বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, এশিয়ার অন্যতম আধুনিক রাষ্ট্র মালয়েশিয়ায় ২০০২ সাল থেকে শুরু হয় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরণ। এক হিসেব অনুযায়ি বর্তমানে বৈধ অবৈধ শ্রমিকের সংখ্যা সাত লাখ। এর মধ্যে সে দেশের সরকার ৬পি প্রোগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৪ লাখ শ্রমিককে এক বছর আগে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করে। ওই ৬পি নিয়ে উদ্বেগের শেষ ছিলনা প্রবাসীদের মাঝে। সব সময় একটা আতঙ্ক বিরাজ করেছে প্রবাসী শ্রমিকদের মাঝে।
মালয়েশিয়া আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শাহিন সরদার অভিযোগ করে বলেন, শ্রমিকদের সমস্যার ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেনি হাইকমিশন। তাদের দায়িত্বহীনতায় ৬০ হাজার শ্রমিক অসহায় জীবন অতিবাহিত করছেন। একদিকে গ্রেফতার আতঙ্ক অন্য দিকে দালালদের দৌরাত্ম তাদের প্রবাস জীবনে যন্ত্রনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। শ্রমিকদের কাছে বড় আতঙ্ক দালাল। ফলে সর্বস্ব হারিয়ে এক সময় দালালদের উপর চড়াও হন শ্রমিকরা। মারামারির ফলে পরিনাম হয় জেল। প্রতারনা, দালালি, ঘুষ-দুর্নীতি, মানব পাচারসহ ফৌজদারি নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন প্রবাসীরা। প্রতিদিনই পুলিশ আটক করে শ্রমিকদের। এদের মধ্যে অপরাধ প্রমানিত না হলে পুলিশ ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেয়া হয়, আর প্রমানিত হলে মুখোমুখী হতে হয় আদালতের।
হাইকমিশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ি বর্তমানে হাজত খাটছেন প্রায় ৩৫০ জন বাংলাদেশি প্রবাসী। আর নানা কারনে পুলিশ ক্যাম্পে আটক আছেন প্রায় ৭৫০ জন। এটি সরকারি হিসেব, বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা ১৭০০ বলে মনে করেন প্রবাসীরা। তবে ৪০ হাজার শ্রমিক বৈধ হওয়ার সুযোগ নেননি। ৫ম মেয়াদে বৈধ হওয়ার সুযোগ শেষ হওয়ার পর থেকে পুনরায় আটক অভিযান শুরু করলো মালয়েশিয়া সরকার। এক সপ্তাহের সাড়াঁশি অভিযানে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ হাজারেরও অধিক মহিলা-পূরুষ শ্রমিককে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৯শ এর অধিক বাংলাদেশী রয়েছেন বলে জানা গেছে। ১০৯টি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০ হাজার ৭৪০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সে দেশে বসবাসরত শ্রমিকরা এই অভিযানে আতঙ্কিত হয়ে বন-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন। সারাদেশে মোট ১০৯টি স্থানে অভিযান চালিয়ে গত ২০জানুয়ারি সোমবার রাত ১২টা ১মিনিটে শুরু হওয়া বিশেষ অভিযানে এ পর্যন্ত মোট সাড়ে তিন হাজারেরও অধিক অবৈধ অভিবাসীকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৯৮৬ জন বাংলাদেশী ছাড়াও ১০৯৫ জন ইন্দোনেশীয়, মায়ানমারের ১৯৭ জন রয়েছে। বাকিরা কম্বোডিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপিন্স, চীন, নাইজেরিয়া ও থাইল্যান্ডের নাগরিক।
জানা গেছে, আরও কঠোর হবে মালয়েশিয়া সরকারের আইন। বাসে, রেলপথে, রাস্তায়, বাজারে সব খানে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন সাড়াঁশি অভিযান চালিয়েছে। অনেক শ্রমিক শ্রীঘরে থেকে ফিরতে হবে স্বদেশে। দেশে ফিরতে হলে ও জেল জরিমানার আওতায় থাকবে অবৈধ শ্রমিক। প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের সব স্বপ্ন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে আবার সেই পুরনো পথেই ফিরে যেতে পারে হতভাগা শ্রমিকদের। দিন দিন মালয়েশিয়ায় ওর্য়াক পারমিট পাবার স্বপ্ন তাদের উবে যাচ্ছে। অনেকে ফিঙ্গার প্রিন্ট করে সিরিয়াল নম্বর ও ফিংঙ্গারপ্রিন্টের কপি পাবার পরও ইমিগ্রেশনের নথিতে তাদের নাম নেই। অর্থাৎ তাদের নাম রেজিষ্টেশন হয়নি। আবার অনেকে না জেনে শুনেই অচেনা অজানা কোম্পানীর নাম লিপিবদ্ধ করায় এবং আউটসোর্সিং কোম্পানীর নামে প্যাকেজ পারমিট করতে গিয়ে প্রতারিত হয়ে এখন দ্বারে-দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাসপোর্ট ও টাকা পয়সা দিয়ে প্রতারকের খপ্পরে পড়ে ওর্য়াক পারমিটের দুর্লভ সুযোগটি হাতছাড়া করেছে। ইমিগ্রেশনের জটিল হিসাব বুঝে না শ্রমিকরা! বৈধকরণ সুযোগ পেয়েও বৈধতা পায়নি তারা।
এদিকে যাদের আটক করা হয়েছে তাদের সাত দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান বা যার যার দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে ফেরত পাঠানো হবে। আটক বিদেশীদের তথ্য ইতোমধ্যে বায়োমেট্রিক তথ্যভান্ডারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে তারা আর কখনো মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে না পারে। এ দিকে সাঁড়াশি অভিযানে আটক হওয়া বাংলাদেশী শ্রমিকদের দেশে পাটানোর ব্যাপারে দূতাবাসের ফার্ষ্টসেক্রেটারি এম এসকে শাহীন জানান, সোমবার পর্যন্ত সে দেশের ইমিগ্রেশন বিভাগ থেকে মোট ৩ থেকে ৪শ জনের নামের তালিকা কমিশনে এসেছে। তবে এ তালিকায় অবৈধ বা নানা অপরাধে আটক কিনা উল্লেখ নেই যাদের নাম এসেছে তালিকা অনুযায়ী তাদেরকে খুব শিগগিরই দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে।