১৪ দলের ১১ দলই নেই রাজনীতির মাঠে
মোঃ রাজিব হোসেন, ঢাকা : কাগজ-কলমে বা খাতায় থাকলেও বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ১৪ দলীয় জোটের ১১ দলকে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন এই জোটের ১১ দলই রাজনীতির মাঠে নেই। ওই দলগুলোর নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি গেল ছয় বছরে খুব একটা চোখে দেখেনি দেশের সাধারণ মানুষ। এমনকি শরিক হিসেবে সরকারি কোনো কর্মকাণ্ডেও তাদের সম্পৃক্ততা নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বাংলা নিউজমেইলকে বলেছে, ১৪ দলে এখন ঠিক কতটি দল রয়েছে, তা নিয়েও রয়েছে নানা মত। এই জোটের শরিক আওয়ামী লীগ, হাসানুল হক ইনুর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এবং রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কর্স পার্টি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকেই বলেছেন, ১৪ দলীয় জোটে এখন মাত্র ৯টি দল আছে। মতান্তরে সমালোচকদের নিরীক্ষায় আছে মাত্র ৬টি দল। এর মধ্যে আবার তিনটি দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি স্থবির।
জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অবহেলা, জোটের শরিক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল , জোটের নেতৃত্ব নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, আদর্শগত মতপার্থক্য, ছোট ছোট ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ দলে বারবার ভাঙন এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
১৯৯৮ সালের শেষের দিকে বিকল্প রাজনৈতিক জোট হিসেবে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের ৭টি দলের সঙ্গে আরো চারটি দল মিলে বামপন্থী ও প্রগতিশীল ১১ দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল।
এই ১১ দলে ছিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণফোরাম, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (খালেকুজ্জামান), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মাহবুব), গণতন্ত্রী পার্টি, সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল), শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, বাংলাদেশ গণআজাদী লীগ ও গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি।
দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় ইস্যুতে ১১ দল মাঠে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করছিল। এরই মধ্যে ২০০৪ সালে ৯ দফা দাবিতে ১১ দল, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর) ও জাসদ মিলে একত্রে কর্মসূচি পালন শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল।
২০০৫ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ মহাজোট গঠনের ঘোষণা দিয়ে ২৩ দফা দাবি তুলে ধরে। ২০০৬ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে গড়ে ওঠা ওই জোটে ১১ দল থেকে মাত্র ৭টি দল যোগ দেয়। তখনই জোট ছেড়ে চলে যায় চারটি দল।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনী জোটবদ্ধ হয় রাশেদ খান মেননের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, প্রয়াত নুরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ গণতন্ত্রী পার্টি, হাজী আবদুস সামাদের নেতৃত্বাধীন গণআজাদী লীগ, অজয় রায়ের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট কেন্দ্র, জাকির হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম। পরে অবশ্য মহাজোটে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি। তবে নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে জোট থেকে বেরিয়ে যায় সিপিবি, গণফোরাম, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি এবং গণতন্ত্রী পার্টির একটি অংশ।
ভাঙাগড়ার খেলায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ফের মহাজোট থেকে বেরিয়ে যায় জাতীয় পার্টি। পুরোনো সেই ১১ দলীয় জোটের তিনটি মাত্র দল রয়েছে ১৪ দলীয় জোটে। সব মিলিয়ে বাস্তবে এই জোটের দল সংখ্যা ৯টি। এই ৯টি শরিক দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, ন্যাপ, গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণআজাদী লীগ ও গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি।
বাস্তবের এই ৯টি দলের ৬টির কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই। পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় কমিউনিস্ট কেন্দ্র এবং গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি। শুধু নামেমাত্র রয়েছে ন্যাপ গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল এবং গণআজাদী লীগ। অর্থাৎ ১৪ দলের ১১টি দলই রয়েছে রাজনৈতিক অস্তিত্বের সংকটে। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকায় তাদের দলীয় কর্মকাণ্ড যেমন সীমিত হয়ে পড়েছে তেমনি ১৪ দলীয় জোটকে সক্রিয় করারও উদ্যোগের অভাব রয়েছে নেতৃত্বে থাকা সরকারি দলটির।
অবশ্য আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ চৌধুরী ১৪ দলীয় জোটে ১৪টি দল না থাকার তথ্য মানতে রাজি নন। তার মতে, ১৪ দল একটি রাজনৈতিক আদর্শ ও প্ল্যাটফর্মের নাম। অসাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লড়াই সংগ্রামের নাম। যে যাই বলুক, জোটে ১৪টি দলই আছে।
তিনি আরো জানান, চলতি মাসেই ১৪ দলের বৈঠক ডাকা হতে পারে। ওই বৈঠকে বেশি কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আরো শক্তিশালী করা হবে এই জোটকে।
সাম্যবাদী দলের পলিটব্যুরো সদস্য লুৎফর রহমান বাংলা নিউজমেইল কে বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর একবার মাত্র ১৪ দলের বৈঠক হয়েছে। শিগগিরই বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
গণআজাদী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস কে শিকদার বলেন, ১৪ দল বাস্তবেই আছে। তবে রাজনৈতিক কর্মসূচি একদমই নেই। বৈঠকও হচ্ছে না ঠিকমতো। ঈদের পরে ১৪ দলের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। তবে কবে হবে, সেই দিনক্ষণ তিনি জানেন না।
প্রায় ৬ বছর হলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এই জোট ক্ষমতায় আছে। ২০০৯ থেকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে এই জোট।
এই সময়ে জোটের শরিক দলগুলোর কয়েকজন নেতা সরকারের মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যও হয়েছেন। তবে দলগুলোর সাংগঠনিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি বলে নেতা-কর্মীরা জানান।
জোটবদ্ধ দলগুলোর নেতারা অভিযোগ করেন, ক্ষমতার অংশীদার হওয়ায় এসব দলের একশ্রেণির নেতা-কর্মী ব্যক্তিস্বার্থের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে দলের ওপর।
আবার জোটের শরিক দু-একটি দলের নেতা-কর্মীর দল ছাড়ার ঘটনাও ঘটেছে। ১৪ দলে থাকা-না থাকার বিতর্কে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে তিন দফায় নেতা-কর্মীরা দল ছেড়েছেন। সাম্যবাদী দল থেকেও সম্প্রতি কয়েকজন বেরিয়ে গেছেন।এদিকে আওয়ামী লীগ ছাড়া ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদেরই কেবল মাঠে কর্মসূচি পালন এবং কর্মী জমায়েতের ক্ষমতা রয়েছে। অন্য দলগুলোর এভাবে কর্মসূচি নিয়ে কর্মী জমায়েতের সাংগঠনিক শক্তি নেই। জোটগত তৎপরতা ছাড়া এই দলগুলো অনেকটাই অসহায়।
আবার ১৪ দলের শরিক কয়েকটি দল নিয়ে ১১ দল নামে আলাদা যে জোট রয়েছে, সেটিও এখন সক্রিয় নেই। ফলে মাঠের রাজনীতিতে ১৪ দলের শরিকরা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে।
ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য কামরুল আহসান জানান, ৬৪টি জেলার মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির কমিটি রয়েছে ৫০টিতে। এর মধ্যে ৭ থেকে ৮টি জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই।
জোটের আরেক শরিক দল জাসদের সাধারণ সম্পাদক শরিফ নুরুল আম্বিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাসদেরও কমিটি আছে ৫০টি জেলায়। এর মধ্যে বেশ কিছু জেলায় রয়েছে আহ্বায়ক কমিটি।
পুরোনো দল হিসেবে ন্যাপের একসময় দেশব্যাপী সংগঠন থাকলেও বর্তমানে এ দলটির সাংগঠনিক অবস্থা খুবই করুণ। অধিকাংশ জেলায় ন্যাপের সংগঠন নিষ্ক্রিয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
গণতন্ত্রী পার্টির ২০টির ওপরে জেলা কমিটি রয়েছে বলে এ দলের সাধারণ সম্পাদক নুরুর রহমান সেলিম জানান। সাম্যবাদী দলের ৩ থেকে ৪টি জেলায় কমিটি আছে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র এবং গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টির জেলা পর্যায়ে কোনো কমিটি নেই।
দলের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে কমিউনিস্ট কেন্দ্রের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অসিত বরণ রায় বলেন, ‘আমাদের পার্টি কার্যক্রম মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। আমাদের পার্টি নতুন, যেভাবে কার্যক্রম চালানো দরকার সেটা পারছি না। গোপালগঞ্জ ও কুমিল্লায় আমাদের সংগঠন আছে।’এদিকে আগামী ২৯ নভেম্বর ঢাকায় সমাবেশের কর্মসূচি নিয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি। ওই সমাবেশে বিভিন্ন জেলা থেকে কর্মীদের ঢাকায় আনতে সাংগঠনিক কাজ চলছে বলে দলের নেতারা জানান।
১৪ দল রাজনীতির মাঠে না থাকলেও তাতে প্রভাব পড়ছে না সরকারে। এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় থাকায় অনেকটা নিশ্চিন্তে রয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে অদূর ভবিষ্যতে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় ১৪ দলের সক্রিয় ভূমিকা দরকার হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক লিয়াকত আলী ভূঁইয়া। তবে সবই ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিধারার ওপর নির্ভর করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।