নিজেকে নিয়ে মোদিয়ানোর অভিযোগের শেষ নেই
মহসিন হাসান, ঢাকা : জীবনের টুকরো টুকরো অংশ, এ অংশগুলো নিয়ে এক একটি চরিত্র তৈরি করেন তিনি। এই চরিত্রগুলোর বাঁক থেকেই খুঁজে নেন উপন্যাসের কাহিনি। কখনো কখনো উপন্যাসের উপাদান সংগ্রহ করেছেন মানুষের সাক্ষাৎকার, পত্রিকার নিবন্ধ থেকে; কখনো আবার ডায়েরিতে টুকে রাখা নোট থেকেও। বছরের পর বছর ধরে এভাবেই তিনি লিখে চলেছেন। কখনো আবার একটি উপন্যাসের গল্প থেকেই জন্ম নিয়েছে আরেকটি উপন্যাস। এক কাহিনির চরিত্র অন্য কোনো উপন্যাসে হাজির হয়েছে ভিন্ন কোনো প্রেক্ষাপটে। তার এক একটি বই পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে। তারা যেন একে অপরের প্রতিধ্বনি। তার কাজ মূলত ফ্রান্সে নাৎসি দখল আর তার প্রভাব নিয়ে। স্মৃতি, বিস্মৃতি, পরিচয় এবং অপরাধবোধের হাত ধরে তিনি পাঠককে নিয়ে যান মানবজীবনের অধরা ভাগ্যের দিকে।
পাঠক ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন এ বছরের নোবেলজয়ী সাহিত্যিকের নাম। হ্যাঁ, তিনি প্যাত্রিক মোদিয়ানো। এখানে তার কথাই বলা হচ্ছে। ফরাসি এই সাহিত্যিকের জন্ম ১৯৪৫ সালের ৩০ জুলাই প্যারিসের শহরতলীতে। ঔপন্যাসিক হিসেবেই তিনি বেশি জনপ্রিয়। ফরাসি ভাষাতেই সাহিত্য চর্চা করেন তিনি। প্যারিসে বাস করলেও মোদিয়ানো মিডিয়া থেকে সব সময়ই দূরে থেকেছেন। ১৯৭০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মোদিয়ানো ডমিনিক জারফিউজকে বিয়ে করেন। জিনা ও ম্যারি নামে তাদের দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে। স্কুলের জ্যামিতির এক শিক্ষক রেমন্ড কুইনিয়াউ তাকে লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তারই অনুপ্রেরণায় মোদিয়ানো ১৯৬৮ সালে প্রথম উপন্যাস লেখেন। ২০১০ সালে বইটি জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার পর সর্বোচ্চ বিক্রি হওয়া দশটি বইয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় এই বই। এ পর্যন্ত ৩০টি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। বেশিরভাগ বই-ই ইংরেজিসহ একাধিক ভাষায় অনুদিত হয়েছে। মোদিয়ানার বেশির ভাগ লেখার প্লট রাজধানী প্যারিসকে ঘিরে। তার গল্প-উপন্যাস মূলত আত্মজৈবনিক। তার লেখায় ফুটে উঠেছে জার্মান অধিগ্রহণের পর প্যারিসের জীবনছবি। ২০১১ সালে ফ্রান্স টুডে-তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মোদিয়ানো বলেন, একান্ত নিজের ইচ্ছায় আমি লেখালেখি করি। লেখালেখি কোনো অর্জনের জন্য করি না। এ জন্য আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা ডিপ্লোমা নেই। তবে এই লেখালেখি ছাড়া আর কিছু করার ভাবনা কখনও মনে আসেনি। তবে আমাকে নিয়ে আমার অভিযোগের শেষ নেই। নিজের পুরনো বইগুলো দ্বিতীয়বার পড়তে ভালো লাগে না। কারণ সেখানে আমি আর নিজেকে খুঁজে পাই না। এই বয়সে এসে নিজের তরুণ বয়সের বই পড়াটা অনেকটা একজন বৃদ্ধ নায়কের তরুণকালের অভিনয় দেখার মতো। প্যাত্রিক মোদিয়ানো সম্পর্কে সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিব পিটার ইংল্যান্ড বলেন, মোদিয়ানো ফ্রান্সে পরিচিত নাম হলেও বাইরে ততটা নন। তিনি ছোটদের বই, চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লেখেন। কিন্তু তিনি মূলত ঔপন্যাসিক। তার লেখার থিম হলো স্মৃতি, পরিচয় ও সময়। তার একটি বিখ্যাত উপন্যাস রয়েছে যেখানে একজন গোয়েন্দা তার স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন। পরে খুঁজতে থাকেন তিনি আসলে কে। ইতিহাসের সাহায্য নিয়ে তিনি অনুসন্ধান চালাতে থাকেন। অবশেষে তিনি তার আত্মপরিচয় খুঁজে পান। তার অধিকাংশ উপন্যাস ১৩০ থেকে ১৫০ পৃষ্ঠার। মোদিয়ানো ফ্রান্সে সবচেয়ে সমাদৃত লেখকদের একজন। উপন্যাস লিখে তিনি সাহিত্যিক হিসেবে নিজের জাত চিনিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দখলদার নাৎসি বাহিনীর অধীনে ফ্রান্সের মানুষের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা তার লেখায় উঠে এসেছে। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত জার্মান দখলদারির সময় সাধারণ মানুষের জীবনের গল্প নিজের বিভিন্ন লেখায় নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মোদিয়ানো। এবার সাহিত্যে সম্ভাব্য নোবেলজয়ীর তালিকায় পাঠকপ্রিয়তা ও জনমত জরিপে এগিয়ে ছিলেন কেনিয়ার লেখক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি, সিরিয়ার কবি আদোনিস, আমেরিকার ফিলিপ রথ, ইউক্রেনের সাভতলানা আলেক্সোভিজ এবং ফ্রান্সের প্যাত্রিক মোদিয়ানো। সবাইকে পেছনে ফেলে মোদিয়ানো এই পুরস্কার জিতে নিয়েছেন। এ বছর পুরষ্কারের জন্য ১২০টি মনোনয়ন জমা পড়েছিল সুইডিশ অ্যাকাডেমিতে। এর মধ্যে থেকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয়েছিল ৩৬টি মনোনয়নপত্র।