মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিটিসিএলের গ্রাহক
ডেস্ক রিপোর্টঃ সেবা না পাওয়ায় বিটিসিএল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ল্যান্ডফোনের গ্রাহকরা। এমনকি নানা রকম ছাড় দিয়ে, সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েও ল্যান্ডফোনের নতুন গ্রাহক পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। নতুন গ্রাহক না বাড়ায় রাজস্বও কমে গেছে সরকারি সংস্থার। ধীরে ধীরে অস্তিত্ব সংকটের দিকে চলছে বিটিসিএল। তবু বোধ ফিরছে না, সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আরও বেশি দলবাজি আর ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে ব্যস্ত। বিটিসিএলের সহযোগী সংস্থা মোবাইল ফোন কোম্পানি টেলিটকের অবস্থাও সন্তোষজনক নয়। টেলিটকের প্রতিযোগী মোবাইল কোম্পানিগুলো যেখানে নিয়মিত মুনাফা করছে সেখানে টেলিটক চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে টেলিটকও নতুন গ্রাহক পাচ্ছে না। নতুন সেবা আনতে পারছে না গ্রাহকদের জন্য। থ্রিজিসহ সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়েও টেলিটক গ্রাহকদের আস্থায় যেতে পারছে না।বিটিসিএল বলছে, আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির যুগে মান্ধাতা আমলের ল্যান্ডফোনের গ্রাহক পাওয়া যাচ্ছে না। কলরেট কমানোসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিলেও গ্রাহকরা মোবাইল ফোনের দিকেই ঝুঁকছে।
বিটিসিএল সূত্র জানায়, এক সময়ের ১৮ হাজার টাকা মূল্যের সংযোগ ফি কমিয়ে ঢাকায় ২০০০ টাকা এবং উপজেলা পর্যায়ে ৬০০ টাকা করে নির্ধারণ করেও গ
রারতিলছে না। এখনো প্রায় চার লাখ সংযোগ খালি। কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী অলস সময় কাটাচ্ছেন। কিন্তু বিটিসিএল ব্যবহারকারীরা বলছেন ভিন্ন কথা, সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ধাপে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর পদে পদে হয়রানির যন্ত্রণা রয়েছে। বেশির ভাগ সময় বিকল থাকে ফোনসেট, লাইনের বিভ্রাটও ঘটে অহরহ। টেলিফোন বিকল হয়ে থাকলেও মনগড়া মোটা অংকের বিল হাজির হয় গ্রাহকদের কাছে। আবার নিয়মিত বিল পরিশোধের পরও বছরান্তে ভুতুড়ে বিল পাঠানোরও এন্তার নজির রয়েছে। কোনো সমস্যার কথা দিনের পর দিন জানানো হলেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। গ্রাহকরা এতসব ঝক্কিঝামেলা পোহাতে প্রস্তুত নয়। তাই তারা বিটিসিএলের সংযোগ ফেরত পাঠিয়ে মোবাইল ফোনকে ভরসা করছে। সূত্র জানায়, দেশে বিটিসিএলের ধারণক্ষমতা প্রায় ১৩ লাখ। ল্যান্ডফোনের বর্তমান সংযোগ রয়েছে প্রায় নয় লাখ। বাকি চার লাখ লাইন বছরের পর বছর পড়ে থাকলেও সংযোগ দেওয়ার মতো গ্রাহক পাচ্ছে না। বিটিসিএলের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার পাঁচটি জোনে মোট ধারণক্ষমতা সাত লাখ ৮৪ হাজার ৩১৩টি। এর মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকায় টেলিফোনের গ্রাহক আছে প্রায় পাঁচ লাখ। সুযোগ-সুবিধাও বাড়ানো হয়েছে প্রচুর। ঢাকায় (গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জসহ) নতুন সংযোগ পেতে.একজন গ্রাহককে খরচ করতে হচ্ছে মাত্র দুই হাজার টাকা। আর ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে সংযোগমূল্য মাত্র এক হাজার টাকা। আর অন্যান্য বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলায় নতুন সংযোগের জন্য গ্রাহককে দিতে হয় মাত্র ৬০০ টাকা। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় প্রতি মাসে গ্রাহককে লাইন রেন্ট দিতে হবে মাত্র ১৬০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরে লাইন রেন্ট ১২০ টাকা এবং উপজেলা ও গ্রোথ সেন্টারের গ্রাহকদের দিতে হয় মাত্র ৮০ টাকা। বিটিসিএলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, যোগাযোগের ক্ষেত্রে মানুষ এখন চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না। তাই ল্যান্ডফোনের প্রতি তাদের আগ্রহ আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। অধিকাংশ গ্রাহকই তার যোগাযোগ মাধ্যমটি নিজের সঙ্গে রাখতেই পছন্দ করেন। অর্থাৎ মোবাইল ফোনের প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহ বেশি। তবে ওই কর্মকর্তা মনে করেন, বিটিসিএল যদি চেষ্টা করে তবে গ্রাহক বাড়ানো সম্ভব। এ জন্য সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে এবং গ্রাহকদের কাছে যেতে হবে। কারণ মানুষ এখনো নিজের বাসায় একটা ল্যান্ডফোন রাখতে চায়। কিন্তু নানা ঝক্কিঝামেলা ওই আগ্রহকে দমিয়ে রাখছে। ২০০৮ সালে বিটিটিবিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি (বিটিসিএল) ঘোষণা কর
া হলেও পরিকল্পনায় ঘাটতি এবং বাস্তবায়নজনিত দুর্বলতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি একটি ফলপ্রসূ কোম্পানি হয়ে উঠতে পারেনি। অন্যদিকে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা ও নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বিটিসিএলের আয় উদ্বেগজনকভাবে কমে যায়। এ ছাড়া বেআইনিভাবে বিটিসিএলের গেটওয়ে ব্যবহারের মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপি চালিয়ে যাওয়ায় বিটিসিএল বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। এতসব সংকটাপন্ন অবস্থার মধ্যেও রাজনৈতিক বিবেচনায় পদায়ন, বদলি ও পদোন্নতি, জবাবদিহিতার অভাব, প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, প্রাইভেট কোম্পানিকে অবৈধভাবে সুবিধা প্রদান, সিবিএ নেতাদের দুর্নীতি, সেবার বিনিময়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অবৈধ অর্থ আদায়, পরিবহন খাতে দুর্নীতিসহ বহুমাত্রিক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে বিটিসিএল মুখ থুবড়ে পড়ছে।দেউলিয়া হওয়ার পথে : কোম্পানি হওয়ার পর প্রথম বছর মুনাফা করলেও পরের টানা চার বছর লোকসান থেকে বেরুতে পারছে না বিটিসিএল। প্রতি বছর লোকসান কেবল বাড়ছেই। সর্বশেষ ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫৪৪ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে কোম্পানিটিকে। দেশের বৃহত্তম ল্যান্ডফোন অপারেটরটি বড় ধরনের লোকসানে পড়লেও সর্বশেষ অর্থবছরে লাভের মুখ দেখেছে বেসরকারি টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলো। শেষ হওয়া অর্থবছরে বিটিসিএল আয় করেছে
১ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। আর ব্যয় করেছে ১ হাজার ৬০২ কোটি টাকা।আয় কমার কারণ হিসেবে কোম্পানিটির কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক টেলিফোন কল থেকে রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার উল্লেখ করেছেন। তাদের যুক্তি, আন্তর্জাতিক কল টারমিনেশনের ক্ষেত্রে এখন অনেক অপারেটর তৈরি করেছে সরকার। অথচ এক সময় একচ্ছত্রভাবে এর দখলদারিত্ব ছিল বিটিসিএলের। আন্তর্জাতিক টেলিফোন কল থেকে এক সময় এক হাজার থেকে ১২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত আয় হলেও গত অর্থবছরে তা নেমে এসেছে মাত্র ৪০১ কোটি টাকায়। তবে স্থানীয় আয় আগের মতোই আছে। কিন্তু আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, তারা আয় বৃদ্ধি এবং ব্যয় সঙ্কোচনের চেষ্টা করছেন।লোকসানের ধকল : ২০১২-১৩ অর্থবছরে বিটিসিএলের অপারেটিং লোকসানের পরিমাণ ছিল ৬০২ কোটি ৯০ লাখ টাকা। গত ২৪ জুন জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নে এ তথ্য পাওয়া যায়। বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ক্রমাগত লোকসানের বোঝা টানছে বিটিসিএল। ফলে সংস্থাটির ব্যাংকের স্থায়ী আমানত (এফডিআর) ভাঙিয়ে কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হচ্ছে। গত অর্থবছরে বিটিসিএল অপারেটিং লোকসান দিয়েছে ৫৪৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে এফডিআর ভাঙিয়েছে ৪২০ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে ৯৬
৪ কোটি টাকার লোকসানে পড়েছে সংস্থাটি।২০১১-১২ অর্থবছরে মাত্র ১০০ কোটি টাকা লাভ ছাড়া আগের চার বছরই লোকসান দিয়েছে বিটিসিএল। ৩৮১ কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট নিয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে হিমশিম খাছে সংস্থাটি। ফলে গত দুই বছরে লোকসানের ঘানি টানতে গিয়ে কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে কঠিন সংকটে পড়ায় ব্যাংকের এফডিআর ভাঙিয়ে বেতন-ভাতা দিতে হয়েছে।দুর্নীতির কঠিন চক্রে আটকে পড়াবাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানির (বিটিসিএল) কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতির কারণে প্রতি বছর রাজস্ব হ্রাস পাচ্ছে। বিদেশি ইনকামিং কলের ক্ষেত্রেই দুর্নীতিটা বেশি। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছর বিটিসিএলের বৈদেশিক রাজস্ব আয় হয়েছে ১ হাজার ২৩৭ দশমিক ৫৮ কোটি টাকা। তবে প্রাইভেট ক্যারিয়ারগুলোকে সংযোগ দেওয়ার পর বিটিসিএলের বৈদেশিক রাজস্ব ব্যাপক হারে কমতে থাকে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিটিসিএল বৈদেশিক রাজস্ব আয় করে ৬৪২ দশমিক ৯৭ কোটি টাকা। বিটিসিএলের অভিযুক্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরদারির অভাবে অথবা তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতার কারণে বিগত দিনে এমনটি ঘটেছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে জানা যায়। ইতিমধ্যেই দুদকের অনুসন্ধান টিম গত এক বছরের দুর্নীতি অনুসন্ধান কাজ সম্পন্ন করেছে। এ
তে ব্যাপক অনিয়ম খুঁজে পাওয়ায় সর্বশেষ বিগত ১০ বছরের অনিয়ম বা দুর্নীতি অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।লাইন নিয়ে চাঁদাবাজি!দেশে ল্যান্ডফোনের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ার দশায়, তবু বন্ধ হচ্ছে না লাইনম্যানের চাঁদাবাজি! ওপেন সিক্রেট চাঁদার টাকার জন্য তারা লাইন বিকল করে গ্রাহকদের জিম্মি করছে। রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই এ অবস্থা। জানা গেছে, লাইন ঠিক করার নামে লাইনপ্রতি ২০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা নিচ্ছে লাইনম্যানরা। ভুক্তভোগীরা জানান, এলাকাভিত্তিক লাইনম্যানরা স্থানীয়ভাবে তাদের কিছু সহকারী তৈরি করেন। যারা সরকারি চাকুরে নয়। এ টাউটরা চাঁদাবাজির জন্য শিকার চিহ্নিত করে দেয়। খিলগাঁও এলাকার স্কুলশিক্ষিকা রেহানা রহমান রেনু বলেন, ‘মেইন লাইন বন্ধ করে রেখে এসব লাইনম্যান বলে বাসার ভেতরের (ইন্টারনাল) তার নষ্ট হয়ে রয়েছে। আবার যাদের কাছ থেকে চাঁদার টাকা সহজে পেয়ে যাচ্ছে তাদের লাইন চালু করে দিচ্ছে।’এক ব্যবসায়ী বলেন, তার ফোনটি মাসে অন্তত দুবার ডেড হয়ে পড়ে। অভিযোগ দিয়েও সময়মতো প্রতিকার না পেয়ে বিরক্ত হয়ে তিনি ফোনটি বন্ধ করে দিয়েছেন। লালবাগ এলাকার সুমাইয়া রহমান সীমা বলেন, ‘তিন-চার দিন আগের দেওয়া অভিযোগে সাড়া দিলেও লাইনম্যানরা
নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দাবি করেন। এ ছাড়া আমি যখন দেশের বাইরে কথা বলার চেষ্টা করি তখন ভয়েস কোয়ালিটি খুবই নিুমানের পাওয়া যায়।’ গ্রাহকরা বলেন, অভিযোগ কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো ফলই পাওয়া যায় না। বেশির ভাগ সময়ই নম্বরগুলো ব্যস্ত থাকে। আর কষ্ট করে লাইন ধরতে পারলেও যেসব লোক কথা বলে তাতে ফল পাওয়া যায় না। লাইনম্যানরা এখনো ইউনিয়নের কাজে ব্যস্ত। গ্রাহকসেবা তাদের মাথায় নেই।