ঘুরে আসুন মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি
পর্যটন ডেস্কঃ কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি নয় যারা একদিনের ভ্রমণে ঢাকা এবং এর আশেপাশে ঘুরতে যেতে চান তাদের জন্য মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি হতে পারে আদর্শ ভ্রমণস্থান। নারায়ণগঞ্জের মুড়াপাড়ায় অবস্থিত এই জমিদার বাড়ি দেশের অন্যতম এক স্থাপত্যকীর্তি। এমনিতেই নারায়ণগঞ্জে দেখার মতো অনেক কিছু রয়েছে। খুব সকালে রাজধানী থেকে রওনা দিলে জমিদার বাড়ি দেখে সোরাগাঁও লোকশিল্প জাদুঘর, বাংলার তাজমহলও দেখে আসতে পারবেন। অর্থাৎ পরিকল্পনা করে ঘর থেকে বের হলে একদিনের ভ্রমণেই তিনটি জায়গা ঘুরে আসা যাবে।
আমাদের দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু পুরনো স্থাপনা, যার বেশিরভাগেরই অবস্থা খুব ভালো নয়। কোনো কোনোটি অযত্ন অবহেলায় ভেঙে পড়ার উপক্রম। পার্শবর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে তাদের রয়েছে বিশেষ মনোযোগ। আর সুদূর ইউরোপের কথা তো বলা বাহুল্য। ফ্রান্সে এক কোদাল মাটি খুঁড়তে গেলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হয় । কারণ কোদালের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আবিষ্কৃত বা অনাবিষ্কৃত কোনো পুরাতন প্রাচীন স্থাপনা অথবা নিদর্শন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর উল্টো। এ দেশে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা বা নিদর্শনের ইট খুলে নির্মাণ করা হয় ঘড়বাড়ি। কখনও কখনও গুঁড়িয়ে দিয়ে তৈরি করা হয় রাস্তা বা দালানকোঠা অথবা ব্যবহৃত হয় স্কুল কলেজ হিসেবে। এমনই পরিস্থিতির মুখোমুখি মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি।
১৭.৫০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ির সদর দরজার সামনে দিয়ে বয়ে গেছে শীতলক্ষা নদী। সে সময় যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিলো নৌ-পথ, সে কথা মাথায় রেখেই বোধহয় বাড়িটি নদীর পাড় ঘেষে নির্মাণ করা হয়েছিলো। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা দুই তলা একটি দালানকে কেন্দ্র করে বিশাল আয়তনের এই বাড়ি। সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করেই বড় খোলা প্রান্তর। হাতের বামে দুইটি মন্দির কক্ষ, তার পেছনেই বিশাল আম বাগান। প্রান্তর পেরিয়ে গেলে বাঁধানো চারটি ঘাটবিশিষ্ট একটি পুকুর। পুকুরের সামনেই খোলা সবুজ মাঠ। জমিদার বাড়ির মূল ভবনের পেছনে পাকা মেঝের একটি উঠান। উঠানটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। কারণ এর চারপাশ দ্বীতল দালানদ্বারা বেষ্টিত। উত্তর পাশেরটি অন্দর মহলের মন্দির। ভবনের এই অংশের পেছনেও রয়েছে আরেকটি দালান।
জমিদার বাড়িটি বর্তমানে কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কলেজের একাধিক শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করে এর ইতিহাস বা আদি-অন্ত কিছুই জানা সম্ভব হলো না। কলেজের প্রধান সহকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান, ১৮৮৯ সালে রাম রতন ব্যানার্জী এখানে জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন পুরান ঢাকার তাঁতী বাজারের ব্যবসায়ী। মূলত সেই জমিদারীকে প্রসারিত করেন তার ছেলে বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জী। তিনি জমিদারী পান ১৮৯৯ সালে। বিজয় বাবুর দুই ছেলে জগদীশ ও আশুতোশ। বড় ছেলে হওয়ার সুবাদে পরবর্তী জমিদার হন জগদীশ ব্যানার্জী। তাদের জমিদারী মূলত তিন পুরুষেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান বিভক্তির পর জগদীশ বাবু পরিবারসহ কলকাতায় পাড়ি জমান।
ভবনের সামনের পুকুরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, পানি কম বেশি হওয়ার ব্যাপারটি ছিল শীতলক্ষার সাথে সম্পর্কিত, কারণ এই পুকুর মাটির নিচ দিয়ে নদীর সাথে সম্পর্কযুক্ত। সম্মুখ ভাগে পুরো সীমানাজুড়ে লাগানো পাম গাছের সারি এখনও রয়ে গেছে। জমিদারের দুইটি হাতি ও একটি শক্তিশালি লাঠিয়াল বাহিনীও ছিল বলে জানা যায়।
তারা দেশ ত্যাগ করলে তৎকালীন সরকার এক চুক্তির মাধ্যমে এই ভবনে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে। পরে এটি কিশোর সংশোধনী কেন্দ্র হিসেবেও কিছুকাল ব্যবহৃত হয়। ১৯৭১ এর পরপরই কিশোর সংশোধনী কেন্দ্র স্থানান্তরিত হয় খুলনায়। এরপর ঢাকায় অবস্থানরত বিহারীদের এখানে বসবাসের অনুমতি দেয়া হয়। যদিও তা খুব কম সময়ের জন্য। এক বছর পরেই বিহারীদের ঢাকার মিরপুরে সরিয়ে নিলে, সেবছরই এখানে স্থানান্তরিত হয় মুড়াপাড়া কলেজ। বর্তমানে জমিদার বাড়ি কলেজের মালিকানাধীন।
মূল ভবনের সম্মুখভাগ চকচকে দেখালেও প্রকৃত অবস্থা আসলে ভালো নয়। পেছনের ভবনগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে বাসস্থান হিসেবে। কলেজের একাধিক কর্মচারী পরিবার নিয়ে সেখানে বাস করেন। বারান্দার রেলিং, নকশা করা দরজা জানালাসহ শৈল্পিক সিঁড়ি এবং অন্দর মহলে প্রবেশের লৌহদ্বার সবই প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। দ্বিতীয় তলা থেকে ছাদে ওঠার কারুকর্যময় মজবুত লোহার সিঁড়িটি ভেঙে গেছে। প্রবেশদ্বারে মন্দির কক্ষ দুটির অবস্থাও সঙ্গীন। রক্ষণাবেক্ষণ আর যথেষ্ট নজরদারির অভাবে অচিরেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে ইতিহাসের ঐশ্বর্যমণ্ডিত এই স্থাপনা।
ছবি : লেখক
ধারাবাহিকভাবে ছবি পরিচিতি :
প্রধান ফটকের পাশে মন্দির।
অন্দর মহলে প্রবেশের দরজা।