কিছুটা কমেছে ঋণের সুদহারের ব্যবধান
অর্থনৈতিক প্রতিবেদকঃ বিদ্যুৎ, গ্যাস সঙ্কটসহ নানাবিধ কারণে দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকায় ব্যাংক খাতে প্রচুর অলস অর্থ জমা হচ্ছে। আর তাই ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে আমানতের পাশাপাশি ঋণেও সুদহার কিছুটা কমাতে শুরু করেছে। যার ফলে ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) কিছুটা কমেছে। তবে এখনো তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার ওপরে রয়েছে। সেপ্টেম্বরে ব্যাংক খাতে মোট স্প্রেড দাঁড়িয়েছে পাঁচ দশমিক শূন্য এক শতাংশীয় পয়েন্ট। যা এর আগের মাস আগস্টে ছিল পাঁচ দশমিক ১২ শতাংশীয় পয়েন্ট। যদিও সুদহারের ক্ষেত্রে ২৬টি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে কম সুদে আমানত সংগ্রহ করে বেশি সুদে ঋণ বিতরণ করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাংক ঋণের ঊর্ধ্বমুখী সুদহারের কারণে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তাদের মতে, ঋণের সুদহার বেশি হওয়ায় উদ্যোক্তারা ব্যাংকবিমুখ হয়ে পড়ছেন। ফলে দেশে নতুন কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। সেইসঙ্গে নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে না। এর ফলে ব্যাংকের মুনাফায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে তারা আশংকা প্রকাশ করেন। তাই ব্যাংক মালিকদের নিজেদের স্বার্থেই আমানতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঋণের সুদহারও কমানোর আহ্বান জানান।
জানা গেছে, শিল্পের মেয়াদি ঋণ এবং চলতি মূলধনের জন্য কোনো কোনো ব্যাংক ২০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিচ্ছে। এতে উদ্যোক্তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। পণ্য আমদানিতেও খরচ বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে দেশের ব্যবসায়ীরা পুরোপুরি ব্যাংকবিমুখ হয়ে পড়বেন। ফলে শিল্প কারখানা বন্ধের পাশাপাশি নতুন কোন কর্মসংস্থানও তৈরি হবে না। অন্যদিকে ব্যাংকারদের মতে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কম থাকায় ব্যাংকগুলোতে অলস অর্থ পড়ে থাকলেও আমানতকারীদের নিয়মিতভাবে সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে ব্যাংকের পরিচালনা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর শেষে ঋণ ও আমানত উভয় ক্ষেত্রেই কিছুটা সুদহার কমিয়েছে ব্যাংকগুলো। ফলে দেশের ৫৭টি ব্যাংকের ঋণের গড় সুদহার কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। যা আগের মাস আগস্ট শেষে ছিল ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এসময় আমানতে গড় সুদহারও কিছুটা কমে সাত দশমিক ৬৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যা আগস্ট শেষে ছিল ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এতে ব্যাংকিং খাতে গড় স্প্রেড (ঋণ-আমানতের ব্যবধান) দাঁড়িয়েছে পাঁচ দশমিক শূন্য এক শতাংশীয় পয়েন্ট। যা আগস্ট শেষে ছিল পাঁচ দশমিক ১২ শতাংশীয় পয়েন্ট। প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে বিশেষায়িত খাতের বেসিক ব্যাংকের স্প্রেড দাঁড়িয়েছে পাঁচ দশমিক ৪৪ শতাংশীয় পয়েন্ট। যা এর আগের মাস আগস্টে ছিল ছয় দশমিক ১৩ শতাংশীয় পয়েন্ট। এছাড়া বেসরকারি ও বিদেশি মালিকানার আরো ২৫টি ব্যাংকের ঋণ-আমানতের ব্যবধান পাঁচ শতাংশীয় পয়েন্টের ওপরে রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণে গড় সুদ হার কমে ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ হয়েছে। আর আমানতের গড় সুদহার কমে দাঁড়িয়েছে সাত দশমিক ৭৫ শতাংশ। যা আগের মাসে ছিল সাত দশমিক ৯৪ শতাংশ। এতে তাদের স্প্রেডের ব্যবধান পাঁচ দশমিক ৪১ শতাংশীয় পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের স্প্রেড সবচেয়ে বেশি। এ ব্যাংকের ঋণ-আমানতের ব্যবধান ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশীয় পয়েন্ট। এরপরে ডাচ-বাংলার সাত দশমিক ৫২ শতাংশ ও ওয়ান ব্যাংকের ঋণ-আমানতের ব্যবধান সাত দশমিক ১৩ শতাংশীয় পয়েন্ট। এছাড়া বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকের পাঁচ দশমিক ৬২ শতাংশ, দি সিটি ব্যাংকে ছয় দশমিক ৫৪, আইএফআইসি ব্যাংকের ছয় দশমিক ৩৬, পূবালীর পাঁচ দশমিক ৩৫, উত্তরা ব্যাংকের ছয় দশমিক শূন্য পাঁচ, ইস্টার্ন ব্যাংকের ৫ দশমিক ২৪, প্রাইম ব্যাংকের পাঁচ দশমিক শূন্য সাত, সাউথইস্ট ব্যাংকের পাঁচ দশমিক ৬৬, ঢাকা ব্যাংকের ৫ দশমিক ৭২, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে পাঁচ দশমিক ৫১, এক্সিম ব্যাংকের পাঁচ দশমিক ২৯, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে পাঁচ দশমিক ৫৬, প্রিমিয়ার ব্যাংকে ৬ দশমিক ৫৪, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে পাঁচ দশমিক ৫৯ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়ায় পাঁচ দশমিক ৩৮ ও যমুনা ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের ব্যবধান পাঁচ দশমিক ৩৭ শতাংশীয় পয়েন্ট।
এদিকে, বিদেশি মালিকানার ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানতের ব্যবধান সবচেয়ে বেশি। এসব ব্যাংকের গড় স্প্রেড আট দশমিক শূন্য চার শতাংশীয় পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদহার কমে তিন দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং ঋণের সুদহার কিছুটা কমে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ রয়েছে। এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের স্প্রেড নয় দশমিক ৮৭ শতাংশ, সিটি ব্যাংক এনএ’র আট দশমিক ৪৪, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনের ছয় দশমিক ৮৮, ওরি ব্যাংকের সাত, এইচএসবিসি ব্যাংকের স্প্রেড ছয় দশমিক ৮৮, ব্যাংক আল-ফালাহ্’র স্প্রেড পাঁচ দশমিক ২৯ শতাংশীয় পয়েন্টের ওপরে রয়েছে। এদিকে, রাষ্ট্রীয় মালিকানার চার ব্যাংকের ঋণে গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশে। আমানতে সুদ হার সাত দশমিক ১৬ শতাংশ। এতে তাদের স্প্রেডের ব্যবধান তিন দশমিক ৫৭ শতাংশীয় পয়েন্ট। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো গড়ে ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়েছে। আমানতে সুদ দিয়েছে মাত্র নয় দশমিক ১৮ শতাংশ। এতে তাদের স্প্রেড দাঁড়িয়েছে দুই দশমিক ৭০ শতাংশীয় পয়েন্ট।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমানত ও ব্যাংক ঋণের সুদের হারের মধ্যে ব্যবধান (স্প্রেড) কোনো অবস্থাতেই পাঁচ শতাংশের বেশি হতে পারবে না বলে নির্দেশ দিয়েছিল। তবে গত অর্থবছরের বেশিরভাগ সময় অধিকাংশ ব্যাংক এ নির্দেশনা অমান্য করেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে।
– See more at: http://www.bdmail24.net/bn/article/24807/#sthash.UTfKoEYq.dpuf