বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|Sunday, December 22, 2024
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » এভিয়েশন » ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প

ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প 

ডেস্ক রিপোর্টঃ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা-সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তির (টিকফা) ফলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প খাত। টিকফা চুক্তির একটি বড় প্রস্তাবনা হচ্ছে বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ স্বত্বাধিকার (ট্রিপস) আইনের কঠোর বাস্তবায়ন। তাই ২০০১ সালের দোহা ঘোষণা অনুযায়ী ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ওষুধের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ববিষয়ক বিধিনিষেধ থেকে বাংলাদেশ যে ছাড় পাচ্ছে, তা আর বাড়বে না। দোহা চুক্তির ওই সুবিধা গ্রহণ করে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো পেটেন্ট করা বিভিন্ন ওষুধ উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করতে পারছে।medi

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, দেশের বাজারে এখন বছরে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয়। দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো বার্ষিক প্রয়োজনের প্রায় ৯৭ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদন করছে। মাত্র যে ৩ শতাংশ ওষুধ এখনও আমদানি করা হচ্ছে, সেসব উচ্চ প্রযুক্তির ওষুধের কয়েকটি আবার এরই মধ্যে দেশেও উৎপাদন শুরু হয়েছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশেই ওষুধের স্থানীয় উৎপাদন বাংলাদেশের মতো নয়। বাংলাদেশ মাত্র ৩ শতাংশ ওষুধ আমদানি করছে। অথচ প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ওষুধ আমদানি করে তাদের বার্ষিক চাহিদার ৯০ শতাংশ। শ্রীলংকা ৮৫ শতাংশ ও সিঙ্গাপুর ৭৫ শতাংশ।

অধ্যাপক ফারুক বলেন, বাংলাদেশের ওষুধ রফতানির সম্ভাবনাও অত্যন্ত উজ্জ্বল। টাকার পরিমাণে এখন বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার ওষুধ রফতানি হচ্ছে। পরিমাণটি খুব বেশি না হলেও সার্বিক বিবেচনায় প্রাথমিক হিসাবে খুব কমও নয়।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম মাসেই ওষুধের রফতানি গত বছরের তুলনায় ৩১ শতাংশ বেড়েছে। ইপিবির হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে ৭২ লাখ ৭০ হাজার ডলারের ওষুধ রফতানি হয়েছে। গত অর্থবছরে একই সময়ে এই পণ্যের রফতানির পরিমাণ ছিল ৫৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। জুলাই মাসের এই রফতানি ছাড়িয়ে গেছে ইপিবি নির্ধারিত রফতানির লক্ষ্যমাত্রাকেও। জুলাই মাসে যেখানে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৭ লাখ ডলার, সেখানে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি রফতানি হয়েছে।

এর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে পাঁচ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের ওষুধ রফতানি হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ছয় কোটি ৯২ লাখ ডলারের ওষুধ। এক বছরের ব্যবধানে ১৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ রফতানি বেড়েছে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে মিয়ানমার, শ্রীলংকা, কেনিয়া, ফিলিপাইন, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের প্রায় একশ’টি দেশে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রফতানি হয়েছে।

বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের শুরুটা এমন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। শুরুতে অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে এ শিল্পকে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে মাত্র তিনটি উল্লেখযোগ্য ওষুধ উৎপাদক কোম্পানি ছিল, সেগুলো হলো ফার্মাপাক, অ্যাড্রুক ও অ্যালবার্ট ডেভিড। এ তিনটি ছাড়া যেসব ওষুধ কোম্পানি ছিল, তাদের ওষুধ পরিমাণে এবং মানে উল্লেখ করার মতো ছিল না। সব কোম্পানি মিলে সাকল্যে ২০ শতাংশ স্থানীয় ওষুধের চাহিদা মেটাত। অ্যালবার্ট ডেভিডের মালিক ছিলেন অবাঙালি। তিনি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ থেকে চলে যান। অ্যাড্রুক পড়ে মূলধনের সংকটে। ফার্মাপাক নাম বদলে হয় ফার্মাদেশ। স্বাধীনতার আগে স্থানীয় চাহিদার বাকি যে ৮০ শতাংশ ওষুধের প্রয়োজন হতো, সেটা আসত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। হঠাৎ করে স্থানীয় দুটি কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ওষুধ আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সদ্য স্বাধীন দেশ ওষুধের তীব্র সংকটে পড়ে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকায় সে সময় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সদ্য স্বাধীন দেশে ওষুধ বিক্রিতে অনীহা দেখায়। কঠিন ওই সময়ে এগিয়ে আসে হাঙ্গেরি, হাঙ্গেরির ইগিস, গেইডেন রিখটার, কাইরন, মেডিম্পেক্স। তারা রাজি হলো বার্টার ট্রেডে। ওরা পাঠাবে ওষুধ। বিনিময়ে বাংলাদেশ পাঠাবে পাট ও অন্যান্য কাঁচা পণ্য। ওষুধের মূল্য ধরা হয়েছিল এক্স ফ্যাক্টরি প্রাইস, মানে মূল উৎপাদন খরচ।এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সময় লেগেছে এক দশকের বেশি।

বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সদস্যরা জানান, ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিদেশি ওষুধ কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাণিজ্য থেকে মুক্তি পেয়েছে দেশীয় শিল্প। দেশীয় কোম্পানিগুলো ক্রমান্বয়ে নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে জায়গা দখল করেছে। অনেক প্রভাবশালী বিদেশি ওষুধ কোম্পানি বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে। তাদের দাবি, এ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পেঁৗছে গেছে বাংলাদেশ। এখন টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে এই এগিয়ে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

টিকফা চুক্তির কারণে বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক ইত্যাদির লাইসেন্স ব্যয়সহ উৎপাদন খরচ বাড়বে। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে জীবনরক্ষাকারী অনেক ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত চড়া দামের কারণে ওষুধের অভাবে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, টিকফা স্বাক্ষর করা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই মেধাস্বত্ব আইন মানতে বাধ্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটি ঘটবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। ফলে অনেক ওষুধ কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ওষুধশিল্পে সম্ভাবনা হারিয়ে বাংলাদেশ হুমকির মুখে পড়তে পারে। কয়েক গুণ বেশি দামে বিদেশি কোম্পানির পেটেন্ট করা ওষুধ খেতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো ওষুধ নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশ উদ্ভাবন বা আবিষ্কার করেছে, বাংলাদেশের পেটেন্ট রাইটস আছে_ এমন একটি ওষুধও নেই।

ডি সিক্সটিন ফার্মা অ্যান্ড বায়োটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. পিনাকী ভট্টাচার্য নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, একবার নাইজেরিয়ায় একটা প্যারাসিটামল কিনেছিলাম, যেটা আমেরিকান পেটেন্ট করা। সেই প্যারাসিটামলের দাম যেখানে বাংলাদেশে এক টাকার কম, সেটা নাইজেরিয়ায় বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৭ টাকা লেগেছিল। বাংলাদেশের তুলনায় অতিরিক্ত যে ২৬ টাকা দিতে হয়েছিল, সেটি পেটেন্ট বা মেধাস্বত্বের মূল্য। মেধাস্বত্বের মূল্য সব সময় মূল পণ্যটির চেয়ে কয়েক গুণ হয়ে থাকে। তিনি বলেন, পেটেন্ট কোনো প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্ব দিয়ে দেয়। ফলে যার নামে পণ্যটি পেটেন্ট করা আছে, সে-ই মেধাস্বত্বের ভিত্তিতে সেই পেটেন্টের সঙ্গে সম্পর্কিত যে কোনো বাণিজ্যে স্বত্ব দাবি করতে পারে। যেমন নিমের পেটেন্ট করা আছে আমেরিকার নামে, তাই নিমগাছ থেকে উৎপাদিত যে কোনো পণ্যে আমেরিকা স্বত্ব দাবি করতে পারবে।ভ্যারিতাস ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শারিতা মিল্লাত বলেন, ট্রিপস বাস্তবায়নের পরও দোহা ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশসহ ৪৯টি উন্নয়নশীল দেশ ওষুধ উৎপাদন ও রফতানির ক্ষেত্রে সুবিধা পাচ্ছে। এ সুবিধা ২০২১ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা চলছে এবং বাড়ানো সম্ভব হলে দেশের ওষুধশিল্পের ওপর ট্রিপসের কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। তবে সরকার এ শিল্পটিকে সব সময় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করছে বলে তিনি জানান।

ওষুধশিল্পের এই সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখে বাজেটে শিল্পটিকে নানা রকম সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর হোসেন মলি্লক বলেন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির অনুরোধে এবং ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষের সুপারিশে ব্যাপকভাবে বিকশিত ওষুধ শিল্প খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অগ্র ও পশ্চাৎমুখী শিল্পের অধিকতর বিকাশের লক্ষ্যে ৪০টি মৌলিক কাঁচামালের ওপর বিদ্যমান ১০ ও ২৫ শতাংশ শুল্ককে হ্রাস করে ৫ শতাংশ রেয়াতি হারে ধার্য করা হয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহার্য ওষুধ তৈরির ১৪টি কাঁচামালের বিদ্যমান শুল্ক সম্পূর্ণ মওকুফের প্রস্তাব করা হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী বলেন, ওষুধের কাঁচামালে শুধু শুল্ক রেয়াত পাওয়ার জন্যই ওষুধ কোম্পানিগুলো রফতানিকে বড় করে দেখায়, এতে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। তার মতে, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক রেয়াত দিয়ে এ শিল্পকে রক্ষা করা যাবে না। প্রয়োজন দেশেই কাঁচামাল উৎপাদনকে উৎসাহিত করা।বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ও ইনসেপ্টা ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদির বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তাগাদা দেওয়ার পর মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ওষুধশিল্পের জন্য অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট (এপিআই) পার্ক স্থাপনের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালে এ পার্কের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে ধাপে ধাপে সময় বাড়ানো হয়েছে। এখন কবে এটি শেষ হবে, তাও আমরা নিশ্চিত নই।

আবদুল মুক্তাদির আরও বলেন, আমাদের ওষুধের মান আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হলেও ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। নেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবি্লউএইচও) অনুমোদিত সরকারি মান যাচাইকারী কোনো ল্যাবরেটরি। এ ধরনের একটি ল্যাবরেটরি স্থাপনের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সে দাবি পূরণ হয়নি। আমি মনে করি, সরকারি ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এবং মান যাচাইকারী ল্যাবরেটরি যদি ডবি্লউএইচওর অনুমোদন পায়, তাহলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ওষুধ খাতের রফতানি বাজারটি হবে ২০ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলারের। সূত্র: সমকাল।

 

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone