দুই নৌকায় পা বিএনপির
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ নানা রকম প্রতিকূল অবস্থা ও রাজনৈতিক গ্যাড়াকলে পড়ে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ‘শ্যাম ও কূল’ উভয় রক্ষার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। বিষয়টিকে দুই নৌকায় পা রাখার সঙ্গে তুলনা করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
জানা গেছে, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় ১৯৯৯ সালে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জামায়াতকে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। ২০০১ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই সরকার গঠন করে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের দলটি।
সূত্রমতে, সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলন ও নির্বাচনের জোট এবং সরকার গঠন করায় নানা মহলের সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। কিন্তু এ সমালোচনাও বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কে এতটুকু ফাটল ধরাতে পারেনি
তবে ২০১০ সালের ২৯ জুন জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদি এবং এর ১৪ দিন পর ২০১০ সালের ১৩ জুলাই জামায়াতের সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান জামান ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা গ্রেপ্তার হলে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হয় বিএনপি।
জানা গেছে, ২০১১ সালের ১০ ডিসেম্বর রোড মার্চ শেষে ১১ ডিসেম্বর সিলেট জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে আটক জামায়াত নেতাদের রাজবন্দি হিসেবে উল্লেখ করে তাদের মুক্তি দাবি করেন খালেদা জিয়া। এর ৭ দিন পর ১৮ অক্টোবর রাজশাহী অভিমুখে রোড মার্চের সময় নওগাঁ পথসভায়ও আটক জামায়াত নেতাদের রাজবন্দি হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাদের মুক্তি চান তিনি।
এছাড়া ২০১১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিএনপির পক্ষ থেকে নয়াপল্টনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতি অনাস্থার কথা জানিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধের দাবি জানান।
এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে জামায়াতের আস্থাভাজন হয়ে ওঠে বিএনপি। কিন্তু ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি জামায়াতের রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরোফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশের মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের রায় দেওয়া শুরু হলে বিএনপি জামায়াতের সম্পর্ক আরেক দফা অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হয়।
একই বছর ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে উঠলে সেই মঞ্চের বিরোধিতা করে আবারও জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় বিএনপি।
কিন্তু জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখতে গিয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সম্ভাব্য বন্ধুদের সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয় বিএনপি। রাজনীতির মিত্র শক্তি হিসেবে কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, অধ্যাপক ড. এককিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারা ও আ স ম আব্দুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে (জেএসডি) জোটবদ্ধ করা তো দূরের কথা যুগপৎ আন্দোলনেও আনতে পারেনি বিএনপি।
সূত্র জানায়, এসব কারণেই জামায়াত ইস্যুতে ‘দু নৌকায় পা’ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। ফলে রাজাকার আবুল কালাম আজাদ, আব্দুল কাদের মোল্লা, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, কামারুজ্জামান, আলী আহাসান মুহম্মদ মুজাহিদি, মতিউ রহমান নিজামী ও মীর কাসেম আলীর রায়ের পর অনানুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি দলটি।
এদিকে রাজনৈতিক মিত্রের এ আচরণে ক্ষুব্ধ হলেও সংকটকাল অতিক্রম করায় বিএনপির সঙ্গে কোনো প্রকার ক্রাশে যেতে চায়নি জামায়াত। তবে সম্প্রতি জামায়াতের সাবেক আমির রাজাকারকূলশিরোমনি গোলাম আযমের মৃত্যুর পর বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি না পাওয়ায় এবং তার মৃতদেহ দেখতে না যাওয়ায় যারপরনাই হতাশ হয় জামায়াত।
তবে এ ব্যাপারে দলের পক্ষ থেকে কেউ মুখ না খুললেও গোলাম আযমের পুত্র আব্দুল্লাহিল আমান আযমী গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপিকে ‘অকৃতজ্ঞ’ আখ্যা দিয়ে বলেন, জামায়াতকে ছাড়া বিএনপি কোনো দিনও ক্ষমতায় আসতে পারবে না।
গোলাম আযমপুত্রের এ ধরনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি (আব্দুল্লাহিল আমান আযমী) জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করেন না। সুতরাং তার বক্তব্য আমরা আমলে নিচ্ছি না।
এরপর রোববার (১৬ অক্টোবর) সৈয়দপুর কর্মীসভায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির আদর্শগত কোনো মিল নেই। তাদের সঙ্গে কেবল আন্দোলন ও নির্বাচনী জোট আছে।
তবে জামায়াত বিএনপির সম্পর্কটাকে ফখরুলের মতো করে দেখছেন না বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। মঙ্গলবার রাতে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, জোটের অংশীদার হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক আগেও যেমন ছিলো এখোনো তেমনটিই আছে। সম্পর্কের কোনো অবনতি ঘটেনি।
এদিকে বিএনপির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, খুব শিগগিরই দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক’র বিষয়টি আরো খোলসা করবেন।
সূত্রটির দাবি, জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির আদেশের পর নীরব থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে বিএনপি- সেটিই বলতে চান খালেদা জিয়া। অপরদিকে বিচারের নানা দোষত্রুটির কথা তুলে ধরে জামায়াতকেও তুষ্ট করতে চান তিনি।
সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের জনসভাগুলোতে জামায়াত নেতাদের মুক্তি দাবিসহ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের সমালোচনা করেছেন খালেদা জিয়া। কিন্তু সম্প্রতি জনসভাগুলোতে এ ব্যাপারে টু-শব্দটুকু করেননি তিনি।
এর প্রতিফলনও দেখা গেছে সর্বশেষ তিনটি জনসভায়। নীলফামারী, নাটোর ও কিশোরগঞ্জে অনুষ্ঠিত ওই জনসভা তিনটিতে জামায়াতের সে রকম কোনো শো-ডাউন দেখা যায়নি।