নতুন কোনো দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না এইচ টি ইমামকে!
ইজাজ ফারুক মেহেদীঃ দলীয় ও সরকারি পদ না গেলেও আপাতত নিষ্ক্রিয় করে রাখা হচ্ছে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামকে। আগের মতো দল ও সরকারে তাকে আর কাজে লাগানো হবে না।পাশাপাশি নতুন করে কোনো দায়িত্বও আর দেয়া হচ্ছে না সাম্প্রতিক সময়ে ‘বিতর্কিত’ হয়ে পড়া সাবেক এ প্রভাবশালী আমলাকে। আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।সূত্র জানায়, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দলের বিজয় নিশ্চিত করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন প্রধানমন্ত্রীর এ উপদেষ্টা
বিশেষ করে নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপনবিষয়ক উপদেষ্টা থাকার সুবাদে প্রশাসনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন সাবেক এ মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি আওয়ামী লীগ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। যে কমিটির চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে নির্বাচনের পর তাকে সংস্থাপন উপদেষ্টার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাজনৈতিক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া দলের প্রচার উপকমিটির প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয় এইচ টি ইমামকে। এর আগে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে দলের পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা রাখায় পরে তাকে এত দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চরম বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে সরকারকে বিপাকে ফেলার অপরাধে কোনো পদ না হারালেও তাকে সব ধরনের দায়িত্ব থেকে আপাতত নিষ্ক্রিয় করে রাখা হবে। আগামী ২৮ নভেম্বর দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে তার প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতে পারে বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র আরো জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর পর এইচ টি ইমাম আওয়ামী লীগ ও সরকারকে চরম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছেন। এ অবস্থায় সিনিয়র, জুনিয়রসহ দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী তার ওপর চরম ক্ষুব্ধ। তারা দলীয় বিভিন্ন ফোরামে বিতর্কিত এ নেতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি জানিয়েছেন। তিনি এ মুহূর্তে কাউকে আর পাশে পাচ্ছেন না। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে কয়েকজন মন্ত্রী এইচ টি ইমামের প্রসঙ্গ তুললে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আসলে তিনি (ইমাম) পেয়েছেনটা কী? নিজে উপদেষ্টা আছেন, ছেলেকে এমপি বানিয়েছেন আবার উপজেলা সভাপতিও করেছেন। তারপরও কেন তিনি এ ধরনের বক্তব্য দিলেন? তিনি আমাকে বারবার ফোন করেছেন, কিন্তু আমি ফোন ধরিনি।’ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য তার ওপর চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা হচ্ছে। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা জানান, বিএনপিবিহীন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সব সমালোচনার রাস্তা বিভিন্ন কৌশলে বন্ধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সেই নির্বাচনের বিভিন্ন কূট-কৌশলের (ম্যাকানিজম) কথা জনসমক্ষে নিয়ে এসেছেন এইচ টি ইমাম।ছাত্রলীগকে দিয়েছেন ‘অবাঞ্ছিত প্রস্তাব’- ‘বিসিএসে তোমরা লিখিত পরীক্ষায় পাস করো, ভাইভাটা আমি দেখব।’ এইচ টি ইমাম কেন এমন বক্তব্য রাখলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও তার কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না। তারা বলছেন, এইচ টি ইমামের এমন বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রাজনীতির মাঠে বল এখন বিএনপি এবং সুশীলদের পায়ে ঠেলে দেয়া হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইতোমধ্যে বলে দিয়েছেন- প্রশাসনে দলীয়করণের যে অভিযোগ বিএনপি করে এসেছে তার প্রমাণ এইচ টি ইমামের বক্তব্য।একই বক্তব্যে নির্বাচনে কারচুপির সত্যতাও দেখছেন সরকারবিরোধীরা। প্রধানমন্ত্রী যখন দেশ-বিদেশে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও ইমেজ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিক তখনি দলের একজন সিনিয়র নেতার মুখে এমন বক্তব্যে বেশ বিপদে পড়েছে সরকার।তার এমন উক্তির কারণে প্রধানমন্ত্রী তার পূর্বনির্ধারিত দু’টি দেশের সফরসূচিও বাতিল করেছেন। তাই তাকে প্রধানমন্ত্রী এমনি এমনি ছেড়ে দেবেন না।আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বিভিন্ন সূত্রের দাবি, এইচ টি ইমামের হাত দিয়ে গত ছয় বছরে ছাত্রলীগের একজনেরও চাকরি হয়নি। ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পদধারী ৩০ থেকে ৩৫ জন নেতা মৌখিক পরীক্ষা দিলেও তাদের চাকরি হয়নি। এ জন্য বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ নেতারা ইমামের বাসায় পর্যন্ত হামলা চালিয়েছেন। ছাত্রলীগ নেতারা বলেন, যখন এইচ টি ইমাম প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন উপদেষ্টা ছিলেন তখন কারো চাকরি দেননি। উল্টো ভিন্ন মতাদর্শের অনেকের চাকরি হয়েছে উপঢৌকনের মাধ্যমে। এখন তার ক্ষমতার লেজ কেটে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ইমাম এখন শুধু রাজনৈতিক উপদেষ্টা- তাই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নিজের আয়ত্তে রাখতেই এ ধরনের প্রলোভন দেখিয়েছেন।আর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নিজ দলীয় মতাদর্শে বিশ্বাসী কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সহায়তার কথা বলে এইচ টি ইমাম নির্বাচন কমিশন ও সরকারের ভাবমর্যাদাকে ঠেলে দিয়েছেন প্রশ্নের মুখে। তাই এমন পরস্পরবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য তার শাস্তি পাওয়া উচিত।আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের একজন সদস্য বলেন, এইচ টি ইমাম ‘৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কোনো প্রতিবাদ না করে খুনি মোশতাকের সরকারকে শপথ পড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর রক্তের সাথে বেঈমানি করেছিলেন। তবুও সব ভুলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন।এবার আবার তিনি কাদের স্বার্থে বা কাদের ইন্ধনে শেখ হাসিনার সরকারকে বিপদে ফেললেন তা দেখা দরকার। তাকে আর ছেড়ে দেয়া উচিত হবে না। শুধু নিষ্ক্রিয় নয়, লতিফ সিদ্দিকীর মতো সব ধরনের পদ থেকেও তাকে অব্যাহতি দেয়া দরকার বলেও জানান তিনিদলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এইচ টি ইমামের ওপর চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাই এখনি দৃশ্যমান কোনো শাস্তি না দেয়া হলেও তাকে এ জন্য তিলে তিলে ভুগতে হবে। দলের উপদেষ্টা ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টার পদ আপাতত খোয়াতে না হলেও তিনি দল ও সরকারে আগের মতো আর প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন না। আর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলেও রোষানলে পড়বেন।