পথ খুঁজে পাচ্ছেন না খালেদা জিয়া
রাজিব হোসেনঃ ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের বর্জনের মুখে নির্বাচন করে দুই সপ্তাহও ক্ষমতায় টিকতে পারেনি বিএনপি। ১৮ বছর পর একই ধরনের একটি নির্বাচন হলো দেশে। এবার ঘটনাপ্রবাহ পুরো উল্টো। নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি এবং তার জোট। বর্জনের মুখে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ সরকারও বিএনপির মতো স্বল্প সময়ের মধ্যে আবার নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবে এমন স্বপ্ন দেখছিল বিএনপি।
নির্বাচন শেষে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর পর অবরোধ স্থগিত করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কমিটি পুনর্গঠন করে আবার আন্দোলনের পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। ভোটারদের অংশগ্রহণ কম থাকায় এই সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে টিকতে পারবে না বলেও ধারণা ছিল বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের। এ জন্যই প্রথমে রোজার ঈদের পর, পরে কোরবানির ঈদের পর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু আন্দোলন শুরুর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না বিএনপি চেয়ারপারসন
।
খালেদা জিয়ার জনসভা এখনও লোকে লোকারণ্য হলেও আগের তুলনায় জন¯্রােত কমার বিষয়টি স্পষ্ট। তার গাড়িবহরে গাড়ির সংখ্যা দিনে দিনে কমে যাচ্ছেÑএমন কথা বলছেন সরকারি দলের নেতারা। আবার বিএনপি কর্মসূচি দিলেও তাতে কর্মীদের অংশগ্রহণ থাকে না তেমন, বিশেষ করে জনগণকে দুর্বার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহী করা নেতারাও যখন কর্মসূচিতে অংশ না নেওয়ায় একই সঙ্গে হতাশ এবং ক্ষুব্ধ করে তুলছে খালেদা জিয়াকে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যে সরকার কয়েক মাসের মধ্যে পরে যাবে আশা করেছিলেন খালেদা জিয়া সে সরকার যখন ১০ মাস পার করেছে এবং দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা নিচ্ছে তখন আগের আন্দোলনের ভুলত্রুটিগুলো নিয়ে খোলাখুলি কথা বলছেন বিএনপি নেতারা। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে রাজধানীতে কর্মসূচি সফল করতে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন খালেদা জিয়াও। আর নির্বাচন শেষে অবরোধ স্থগিত রাখার স্থলে তা প্রত্যাহার করা চরম ভুল বলে এখন মনে করছেন তিনি।
সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে দলের এই ভঙ্গুর দশার জন্য শীর্ষনেতাদের ওপর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। নেতারা কেন আন্দোলনের কোনো পরামর্শ দিতে পারছেন না বা নিজেরা কছু করছেন না সে জন্য ভর্ৎসনাও করেছেন তিনি।
বিএনপির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির এক নেতা মনে করেন, খালেদা জিয়ার এমন প্রতিক্রিয়া হতাশা থেকে। এই সময়কে তিনি বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন খালেদা জিয়া যাদের পরামর্শে বর্জন করেছেন এখন তারা কেউ তাকে কোনো আশা দেখাতে পারছেন না। আমি এবং আরও কয়েকজন বলেছিলাম নির্বাচনে অংশ নিতে। কিন্তু আমাদের তখন চাপে পড়তে হয়েছে এ কথার জন্য। বাস্তবতা হচ্ছে এখন আন্দোলন করার মতো শক্তি আমাদের নেই।’
বিএনপি নেতাদের সূত্র জানিয়েছে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা নিয়েও হতাশা আছে খালেদা জিয়ার মধ্যে। তিনি বিরোধীদলীয় নেতা থাকার সময় পাঁচ বছর এই মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানি পিছিয়েছে। কখনও সংসদের প্রস্তুতির কথা বলে, কখনও বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা বলে বারবার সময় নিয়েছেন তার আইনজীবীরা। কিন্তু এবার সরকার ক্ষমতায় আসার পর আর সে অজুহাত দিতে পারছেন না তার আইনজীবীরা। এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে এরই মধ্যে। বিএনপি নেতাদের আশঙ্কা, এই মামলার দ্রুত শুনানি করে তা শেষ করতে চায় সরকার। আর এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে খালেদা জিয়া নির্বাচন করার যোগ্যতা হারাবেন। এই অবস্থায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি কার নেতৃত্বে অংশ নেবে তা জানা নেই কারও। বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়াও ব্যর্থ হয়েছে বলা চলে। এক মাসের সময় দিয়ে ঢাকা মহানগরে আহ্বায়ক কমিটি করে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। সেটিও চার মাস হতে চললো, কিন্তু একটি ওয়ার্ডে কমিটিও চূড়ান্ত করতে পারেনি তারা। দেশের বিভিন্ন জেলা কমিটি ভেঙে যেসব আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে, সেগুলোর দশাও একই। পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা যায়নি কোথাও। এই অবস্থায় কর্মসূচি পালন দূরের কথা, নেতারা ব্যস্ত নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সামলাতে। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জে খালেদা জিয়ার জনসভা বিএনপির একাংশ বর্জন করেছে ঘোষণা দিয়েই। এ রকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে তাকে কখনও পড়তে হয়নি।
দলের নেতাদের খালেদা জিয়ার ভর্ৎসনা
একই সঙ্গে ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডে বিএনপির কমিটি এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত না করার জন্য এবং ছাত্রদলের ভেতরে দ্বন্দ্ব নিরসনে ব্যর্থতার জন্য তিনি কড়া ধমক দিয়েছেন ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে।
বিএনপির এক নেতা জানান, সম্প্রতি এক দলীয় বৈঠকে মির্জা আব্বাসকে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি যদি আপনাকে দল থেকে বাদ দেই তাহলে আপনার অবস্থানটা কি হবে? আপনি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন? তাই দলের ভিতরে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না করে দল ও দলের ঐক্য ফিরিয়ে আনার কাজ করুন।’
এ বিষয়ে মির্জা আব্বাসের সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
কেবল মির্জা আব্বাস নয়, স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে আন্দোলন জমাতে না পারায় ক্ষুব্ধ খালেদা জিয়া দলের শীর্ষ নেতাদের আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার ‘শেষ’ নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, হয় সক্রিয় হতে হবে নইলে নেতৃত্ব ছাড়তে হবে।
তবে নেতারা যে খালেদা জিয়ার এই আল্টিমেটামকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না তা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহর কথাতেই বোঝা যায়। তিনি বলেন, ‘দিন-সময় ও তারিখ ঠিক করে আন্দোলন হয় না। সরকারকে আমরা নির্বাচন দেওয়ার জন্য সময় দিয়েছি এবং নির্বাচনের জন্য আমরা সরকারকে অনুরোধও করব। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা বিএনপির কথায় কর্ণপাত না করলে ২০ দলীয় জোট তাদের আন্দোলনের কৌশলে দাবি আদায় করে নেবে।’
বিএনপি স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া আমাদের আন্দোলনের নির্দেশনা দিয়েছেন এবং সাংগঠনিক কার্যক্রমের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে কথা শুনিয়েছেন। কিন্তু এটা একান্ত সাংগঠনিক বিষয়। তবে বিএনপি আন্দোলনে আছে ও থাকবে। আর এই আন্দোলনের প্রতিফলন খুব শিগগির আপনারা দেখতে পাবেন।’
আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তাই তাদের আন্দোলন ঘোষণায় বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন বলেন, ‘বিএনপি নেত্রী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আন্দোলনের নামে দেশে সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি করেছিলেন। নির্বাচনের পরও আবারও একই কায়দায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাইছেন। দেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন। তারা এখন হরতাল-অবরোধকে গুরুত্ব দেয় না।’
ব্যর্থতার বৃত্তে ঢাকা মহানগর বিএনপি
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত জোটের কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নেতা-কর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও ঢাকায় তেমন কোনো অংশগ্রহণ দেখা যায়নি। বরং সাধারণ মানুষের ওপর চোরাগোপ্তা হামলায় প্রাণহানিতে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে দলকে। এমনকি নির্বাচন ঠেকাতে খালেদা জিয়ার ঢাকামুখী কর্মসূচি ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’তে কোনো লোকসমাগমই হয়নি। বাড়ি থেকেই বের হতে পারেননি খালেদা জিয়া।
নির্বাচন শেষে এ জন্য ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতাদের সরিয়ে দিয়ে নতুন কমিটি করার লক্ষ্যে ১৮ জুলাই গঠন করা হয় আহ্বায়ক কমিটি। এ কমিটিকে এক মাসের মধ্যে রাজধানীর প্রতিটি ওয়ার্ডের কমিটিগুলোকে পুনর্গঠন এবং দুই মাসের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু চেয়ারপারনের এই নির্দেশ কেবল ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ আছে। ওয়ার্ড কমিটিগুলোর একটিও পুনর্গঠিত হয়নি এবং পূর্ণাঙ্গ কমিটি কবে হবে সেটা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।
চার মাসেও খালেদা জিয়ার নির্দেশ পালিত না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল বলেন, ‘বিভিন্ন কর্মসূচির কারণে এই কাজে কিছুটা ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে। তবে ঢাকা মহানগর বিএনপির ওয়ার্ড কমিটি পুনর্গঠনের কাজ চলছে।’
কবে নাগাদ কমিটিগুলো পুনর্গঠিত হবেÑ জানতে চাইলে এই নেতা বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময় দেওয়া সম্ভব নয়, তবে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওয়ার্ড ও থানা কমিটিগুলো ঘোষণা করব।
ছাত্রদলের কমিটি গঠন করে নতুন বিপদ
রাজিব আহসানকে সভাপতি এবং আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে আন্দোলনে বিএনপির মূল ভরসা ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পর পদবঞ্চিতদের আন্দোলন থামছেই না। বঞ্চিতরা বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলছেন প্রকাশ্যে যা দলটিকে ফেলেছে এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে।
নতুন কমিটি এক মাসেও দলের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানায়নি। অথচ রীতি অনুযায়ী নতুন কমিটি গঠন হলে সাত দিনের মাথাতেই জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানোর কথা ছিল ছাত্রদলের কমিটির।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরাও আলোচনা করছি। সময় হলেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানো হবে। আর হরতাল ও বিএনপির নিজস্ব অনুষ্ঠান থাকায় ছাত্রদলের কাজের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।
ছাত্রদল ইতিমধ্যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নবগঠিত কমিটির একাধিক নেতা। তারা বলেন, নতুন কমিটি এতদিনে কোনো একটি কর্মসূচি দেয়নি এমনকি নিজেদের মধ্যেও কোনো বৈঠক হয়নি। বরং ছাত্রদলের নতুন কমিটি থেকে যারা বাদ পড়েছেন তারা অনেক সক্রিয়।
ছাত্রদল এখন কী করছে জানতে চাইলে সংগঠনের সভাপতি রাজিব আহসান বলেন, ‘আমরা জেলা ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা পুর্নগঠন নিয়ে কাজ শুরু করেছি। এরপর ধীরেসুস্থে সব হবে। একসঙ্গে সব কাজ করা যায় না।’
‘আন্দোলনে’ ছাত্রদলের একাংশ
ছাত্রদলের একাংশের নেতারা এখন আন্দোলনে সক্রিয়। তবে সরকারের বিরুদ্ধে নয়, দলের কমিটি এবং বিএনপি নেতা শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচি পালন করছে তারা। পদবঞ্চিত এই নেতারা বলছেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে তারা। আর আন্দোলনে আমাদের মূল দাবি এ্যানি ও টুকুকে বিএনপি থেকে বহিষ্কারসহ নবগঠিত কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি গঠন।
ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি তরুন দে বলেন, ‘সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক পদে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনেই রাজপথে ছিলেন না। বরং আন্দোলনের জন্য বিএনপির কেন্দ্র থেকে যে ৪০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল তা তারা আত্মসাৎ করেছেন।’ এছাড়াও বর্তমান কমিটিতে বিবাহিত এবং অছাত্ররাই বেশি। –সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে