বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|Sunday, December 22, 2024
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » প্রযুক্তি » ফেসবুক নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ

ফেসবুক নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ 

প্রযুক্তি ডেস্কঃ  বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে পরিচিত ফেসবুক নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত হলেও বর্তমানে ফেসবুকের সূত্র ধরে সমাজে নানা ধরনের অসামাজিকতা ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটছে। ফলে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমের নেতিবাচক দিক নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে ক্রমে বাড়ছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অনেক অভিভাবক।

face2

ফেসবুক প্রথম দিকে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে তা শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষের মধ্যে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বন্ধুত্বের নামে অবাধ মেলামেশার পরিবেশ সৃষ্টি, প্রেম, পরকীয়া, বহুগামিতা, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে অবিশ্বাস-সন্দেহ সৃষ্টি ও ফাটল ধরানো এবং পারিবারিক ভাঙনের পেছনে এ যোগাযোগমাধ্যমের বিশেষ অবদান রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি ছাত্রছাত্রীরা বিয়ের আগেই জড়িয়ে পড়ছে একাধিক সম্পর্কে। কখনো স্বামী বা স্ত্রী আবার অনেক সময় দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই একসাথে একাধিক সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমানে ফেসবুকে ব্যাপক আকারে ভর করেছে পর্নোগ্রাফি। পর্নো ছবি, ভিডিও এবং লেখা সমন্বয়ে অসংখ্য অ্যাকাউন্ট এবং পেজ খোলা হয়েছে। অনেকে নামে-বেনামে বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট খুলে অনবরত অশ্লীল ভিডিও এবং ছবি পোস্ট করে যাচ্ছে। অশ্লীল এসব উপাদান কোনো-না-কোনো উপায়ে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ওয়ালে চলে আসে। তাই সামাজিক এ যোগাযোগমাধ্যমটি নিজেই এখন অনেকটা অসামাজিকতায় ভরপুর হয়ে গেছে বলে মনে করেন অনেকে। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, সঙ্ঘবদ্ধ চক্র যুবসমাজের চরিত্র হননের জন্য ফেসবুকের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

ফলে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বিস্তারলাভকারী এ যোগাযোগমাধ্যমটি নিয়ে অনেকেরই কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করছে। উন্নত বিশ্বে ফেসবুকের প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সমীক্ষা পরিচালিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এসব সমীক্ষায় ফেসবুক আসক্ত এবং ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বিষয়ে অনেক উদ্বেগজনক চিত্র বের হয়ে আসছে। ফেসবুকের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ এবং অনেক অনাকাক্সিত ঘটনার খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। তাই ফেসবুকবিষয়ক সমীক্ষা এবং গবেষণা প্রতিবেদনে বিভিন্ন উপদেশ-পরামর্শ দেয়া হচ্ছে এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য।

২০১০ সালের ২৯ মে বাংলাদেশ সরকার ফেসবুক সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। ওই বছরই ৫ জুন আবার চালু করা হয় ফেসবুক।

তরুণ প্রজন্ম ফেসবুকের মাধ্যমে কী ধরনের সামাজিক যোগাযোগ রা করছে সেটা পর্যবেণের জন্য ২০১০ সালের ৫ জুন সরকার ফেসবুক খুলে দেয়ার পর থেকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে ১০ জন বাংলাদেশী তরুণের ফেসবুক প্রোফাইল বাছাই করে এবং তা পর্যবেক্ষণ করে। এদের পাঁচজন স্কুলছাত্র এবং পাঁচজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া। পর্যবেক্ষণে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কমেন্ট এবং সময় পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেখা যায়, এদের মধ্যে কেউ কেউ রাত ১১টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত এই ওয়েবসাইটের পেছনে সময় ব্যয় করেছে! তাদের ‘অ্যাকটিভিটি’ লিস্ট থেকে দেখা যায় সবাই এই সময়টুকু বিভিন্ন মেয়ের প্রোফাইলে মন্তব্য লিখে কাটিয়েছে। একজন স্কুলছাত্র এক রাতে সর্বোচ্চ ৪১ জন মেয়ের প্রোফাইলের ওয়ালে কিংবা স্ট্যাটাসে মন্তব্য লিখেছে! মন্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, এদের মধ্যে কেউ-ই তাদের পরিচিত নয়। মন্তব্যগুলোর ধরন এরকম, ‘আমি তোমার বন্ধু হতে চাই’, ‘তুমি এত সুন্দরী’, ‘বৃষ্টিতে ভিজলে তোমাকে দারুণ লাগবে’ ইত্যাদি। অনেকে অন্যের ছবির অ্যালবামে ঢুকে সেখানে অশ্লøীল মন্তব্য লিখেছে! তারা নিজেদের ওয়ালে ব্যক্তিগত জীবনের সাধারণ বিষয়াদি এবং অনর্থক মন্তব্য লিখে রেখেছে।

ফেসবুক কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুসারে চলতি বছর ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক কোটি দুই লাখ। আর কোটি ব্যবহারকারীর মধ্যে ওই ১০ জনের চিত্র সত্যিকার পরিস্থিতি বুঝতে তেমন একটা সহায়ক নয়। তরুণ প্রজন্ম ছাড়াও ফেসবুক ব্যবহকারকারী নারী-পুরুষ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসলে সামাজিক হচ্ছে না অসামাজিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছে, তা সত্যিকার অর্থে বোঝা যায় সমাজে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অনাকাক্সিত ঘটনা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের সার্বিক চিত্র থেকে।

ইন্টারনেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ সুবিধা আছে কিন্তু ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই এমনটা এখন বিরল। বিশেষ করে তরুণ-তরুনী এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলছে ফেসবুক ক্রেজ। এ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন অনেক অভিভাবক। শিক্ষক-অভিভাবকেরা জানান, অনেকে দিনের একটি উল্লেøখযোগ্য সময় ইন্টারনেট এবং ফেসবুকে দেয়ার কারণে পড়াশুনায় অমনোযোগিতা, কাস ফাঁকি দেয়ার ঘটনা ঘটছে। কাসে বসেও চ্যাট বা এসএমএস বিনিময় ধরা পড়ছে। সামাজিক যোগাযোগের মধ্যে লিপ্ত হতে গিয়ে অনেকে জড়িয়ে পড়ছে নানাবিধ অনাকাক্সিত সম্পর্ক, ঘটনা এবং জটিলতায়, যা একপর্যায়ে অপরাধমূলক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুত্ব, প্রেম নিবেদন এবং বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে নানা কৌতুক, ব্যঙ্গ কার্টুন তৈরি হচ্ছে।

অনেকে নিছক বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা, তাদের খবরাদি জানা, পুরনো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং নিজের মতামত ও অবস্থান তুলে ধরার জন্য ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুললেও পরে শুধু এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারছে না। প্রযুক্তির নিত্যনতুন উদ্ভাবনের ফলে ফেসবুকও বিস্তৃত হচ্ছে নানা পসরার ডালা নিয়ে। অনেকের কাছে এটা এখন বিনোদনেরও বড় একটা মাধ্যম। অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করলে এমন সব আয়োজন উপাদান সামনে হাজির এবং বিদ্যমান থাকে যে, তার মাধ্যমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একজন পার করে দিতে পারে। তা ছাড়া প্রায়ই বিভিন্ন লিংকের মাধ্যমে অশ্লøীল বিষয়াদি সামনে চলে আসায় তার দ্বারাও প্রভাবিত হচ্ছে অনেকে।

ফেসবুকের নীতিমালায় বলা আছে, কারো ব্যক্তিগত সম্মান কিংবা গোপনীয়তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যাবে না, অশ্লøীল, বীভৎস, শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানিমূলক কিছু ফেসবুকে ঢোকানো যাবে না; কোনো ব্যক্তি, জাতি, ধর্ম, দেশ ইত্যাদির বিরুদ্ধে হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, সহিংসতা ইত্যাদি ছড়ানো যাবে না। এটা মেনে নিয়েই সবাই সদস্য হয়; কিন্তু তা যে নিছক একটা বিষয় তা ফেসবুকের বর্তমান অবস্থায় সহজেই অনুমেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা আচরণ গবেষণা সংশ্লিষ্ট ফার্ম এন্টারপেরিয়েন্স এক প্রতিবেদনে উল্লেøখ করেছে নেশার জগতে আবির্ভূত নতুন উপকরণগুলোর নাম ফেসবুক, টুইটার এবং গুগল। আর এ নেশার জগতে আচ্ছন্ন হওয়াদের মধ্যে বেশির ভাগই তরুণ। অবশ্য যেভাবেই হোক এ জালে জড়িয়ে আছেন অনেক মধ্যবয়সীরা।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড এক প্রতিবেদনে উল্লেøখ করেছেÑ সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করলেও মনের অগোচরেই ব্যবহারকারীদের ক্রমেই নেশাগ্রস্ত করে তুলছে সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুক, টুইটার এবং সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগল। এখানে আরো বলা হয়েছে, অনলাইন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে ফেসবুক, টুইটার এবং গুগলের মতো সাইট পরিদর্শকদের মধ্যে গড়ে ৫৩ জন বিচলিত হয়ে পড়ে। একই কারণে একাকিত্ব যাতনায় ভোগে শতকরা ৪০ জন।

ব্রিটিশ আইনি সংস্থা ‘ডিভোর্স অনলাইন’ গত বছর পাঁচ হাজার বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন পর্যবেক্ষণ করে। এতে তারা দেখতে পেয়েছে বিয়ে বিচ্ছেদের পেছনে অন্যতম ভূমিকা পালন করছে ফেসবুক। তারা জানায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে দম্পতিদের পরস্পরবিদ্বেষী বিবৃতি, বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে সন্দেহজনক ফেসবুক ব্যবহার এবং ইন্টারনেটে আপত্তিকর ছবি প্রকাশ বিয়ে বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেøখ করা হয়েছে বর্তমানে বহু সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে অতিরিক্ত ফেসবুক ও টুইটার ব্যবহারের ফলে। ফেসবুক, টুইটারের অতিরিক্ত ব্যবহারে পুরুষ কী নারী, দু’জনেই একই সময় একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। একাধিক সম্পর্কে একই সময় থাকার ফলে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, বিবাহবিচ্ছেদ, বহুগামিতা ও প্রেমের সম্পর্কে ঠকানোর প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে।

এর সবই ফেসবুকের নেতিবাচক দিক। কিন্তু এর ইতিবাচক ভূমিকাও যুগান্তকারী হিসেবে প্রমাণিত বিভিন্ন প্রেক্ষিত, প্রেক্ষাপট এবং স্থানে। আর এ কারণেই মানুষ এ থেকে দূরে থাকতে পারছে না। কিন্তু পরে কেউ কেউ নিজের অলক্ষ্যেই নিজেকে নেতিবাচক প্রবণতার শিকারে পরিণত করছে। আর অভিভাবকদের উদ্বেগ সেখানেই।

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone