বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|Sunday, December 22, 2024
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » পর্যটন » প্রকৃতির সাজানো পাহাড়ের ঘন সবুজ অরণ্য!

প্রকৃতির সাজানো পাহাড়ের ঘন সবুজ অরণ্য! 

মোঃ রাজিব হোসেনঃ  নদীর নাম গণেশ্বরী। গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা এক চপলা-চঞ্চলা নদী। নদীর একপাশে ভারত সীমান্ত। সেখানে প্রকৃতির নিজ হাতে সাজানো পাহাড়ের সারি। ঘন সবুজ অরণ্য। আরেক পাশে ছোট ছোট টিলা। টিলার পাশ ঘেঁষে গারো, হাজং, হদি, কোচ প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় জনবসতি। নদীর বুকে সূর্য রং-এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিকচিক করে স্বচ্ছ সিলিকা বালি। আর বালির পরতের (স্তরের) নিচ দিয়ে যেন বয়ে চলেছে জলের ধারা; বলা যায়- ঝরনাধারা। মাথার ওপর ভেসে বেড়ায় নীল-সাদা মেঘ। এ যেন এক অপরূপ, শান্ত জনপদ। শুধু নৈসর্গিক সৌন্দর্যই নয়, মুক্তিযুদ্ধ, টঙ্ক ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নানা ইতিহাস, নিদর্শনও ছড়িয়ে আছে সেখানে। বিচিত্র এ জনপদের নাম লেঙ্গুরা

lengura2
কলমাকান্দা সদর থেকে নাজিরপুরের পথে ওঠা মাত্রই দূর থেকে দৃষ্টি কেড়ে নেয় মেঘালয়ের পাহাড় রাজ্য। মনে হয়, সেখানে ঘন কালো মেঘ যেন সেই কবে থেকে মিতালী করে আছে আকাশ-মাটির সঙ্গে। এই পথ ধরে এগিয়ে যান। কিছুদূর এগিয়ে গেলেই পাবেন নাজিরপুর মোড়। এখানেই মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ গড়ে তোলা হয়েছে। একাত্তরে পাকবাহিনীর সঙ্গে ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধ হয়েছিল নাজিরপুরের এই স্থানে। শহীদ হয়েছিলেন সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। নাজিরপুর মোড় হয়ে গণেশ্বরী নদীর পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে লেঙ্গুরা বাজার। দীর্ঘ যাত্রাপথের ক্লান্তি দূর করতে বাজারের বিচিত্র সাংমার দোকানের এক কাপ বেল-চায়ে চুমুক দেয়া যেতে পারে। কাঁচা বেলের শুঁটকি দিয়ে এই বিশেষ চা তৈরি করেন তিনি।
লেঙ্গুরা বাজারের শেষ মাথায় কয়েকশ বছরের প্রাচীন মন্দির। ছোট টিলার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মন্দিরটি কিছুক্ষণের জন্য হলেও আগন্তুকদের কৌতূহল সৃষ্টি করে।  এরপর পাঁচ মিনিটের কাঁচা মাটির পথ পেরুলেই লেঙ্গুরার অঢেল সৌন্দর্য সম্ভারের মুখোমুখি হবেন আপনি। কেননা সেখানে যেন আপনার জন্যই অপেক্ষা করে রয়েছে বিশাল পাহাড় আর ঘন সবুজ বনভূমি। পাহাড়ি এই অরণ্যের শোভা উপভোগ করতে করতেই চোখে পড়বে আদিবাসীদের ঘর। আপনি সেদিকে তাকিয়ে ভাবতে বাধ্য হবেন অরণ্য আর জীবজন্তুর সঙ্গে মিতালী করে গারো, হাজং, হদি, কোচ প্রভৃতি আদিবাসীরা কবে থেকে এখানে বাস করছে? কীভাবেই বা তারা এখনও টিকে আছে?
কিন্তু আফসোস! বড় পাহাড়গুলো ভারত সীমানায় অবস্থিত হওয়ার কারণে সেগুলোতে ওঠা যায় না। কিন্তু তাতে কী, দেখতে তো বাধা নেই! লেঙ্গুরায় বাংলাদেশের সীমানায়ও পাহাড় আছে। সেগুলো ভারতের ওই পাহাড়গুলোর মতো বড় নয়। এগুলো ‘টিলা’ নামে পরিচিত। যেমন- মমিনের টিলা, চেয়ারম্যানের টিলা, গাজীর টিলা প্রভৃতি। মমিনের টিলা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক। বেশ বড় এবং বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত।
সমতল থেকে অনেক উঁচু টিলাটিতে ওঠার জন্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে পাকা সিঁড়ি। সিঁড়ি ছাড়াও গাছের লতা আঁকড়ে ধরে পাথর-মাটির বিকল্প পথ দিয়েও ওঠা যায়। তবে সে পথ বেপরোয়া তরুণদের জন্য। টিলার ওপর পাকা বেঞ্চ ও ছাতা রয়েছে। এই টিলায় দাঁড়িয়ে আপনি দূরের পাহাড় আরো সুন্দর দেখতে পাবেন।  টিলার নিচ দিয়ে বয়ে গেছে গণেশ্বরী- ছবির মতো এক নদী। গারো পাহাড় থেকে অনেকটা ঝরনার মতো নেমে আসা এ নদীটি বর্ষায় থাকে খরস্রোতা। আর শুষ্ক মৌসুমে এর বুকজুড়ে দেখা যায় শুধুই বালি আর বালি। কিন্তু অবাক বিষয় হলো বালির নিচেই রয়েছে পানির প্রবাহ। একটু গর্ত করে খানিক অপেক্ষা করলেই টলটলে পানিতে ভরে যায়। এই পানি দিয়েই গোসলসহ দৈনন্দিন চাহিদা মেটান স্থানীয়রা।
শুষ্ক মৌসুমে গণেশ্বরীকে অনেকটা সমুদ্র সৈকতের মতো মনে হয়। টিলা থেকে নেমে আর একটু পূর্ব দিকে এগুলেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নো ম্যানস্ ল্যান্ড। নো ম্যানস্ ল্যান্ড ঘেঁষে একাত্তরের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক সাত শহীদের মাজার। বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে নেত্রকোনাসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রায় সব মুক্তিযোদ্ধারা মিলিত হন স্থানটিতে। লেঙ্গুরায় কিছুক্ষণ অবস্থান করলেই চোখে পড়ে আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা।
দেখা যায় হাজং নারীদের ‘জাখা’ দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য। পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কৃষিকাজ করছেন কর্মজীবী গারো নারী। আবার কাজ শেষে দুগ্ধপোষ্য শিশুকে গামছা সহযোগে পিঠে ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরছেন কেউ কেউ। আদিবাসী শিশুরা সাইকেলে চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছে বই-খাতা নিয়ে। একটু ঘনিষ্ট হয়ে কথা বললে ধারণা পাওয়া যায় তাদের ব্যতিক্রম ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গেও।
যাবেন যেভাবে : লেঙ্গুরায় পর্যটন শিল্পের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কিন্তু তাতে ভ্রমণপিপাসুরা লেঙ্গুরার সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হবেন এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। এই আকর্ষণীয় স্থানটি নেত্রকোনা জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে। বাসে বা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে প্রথমে যেতে হবে কলমাকান্দা। সেখান থেকে আবার মোটরসাইকেল বা সিএনজি অটো রিকশাতে নাজিরপুর হয়ে সোজা লেঙ্গুরা।

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone