ভারতের ভেতরে যুদ্ধ
ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কঃ আঞ্চলিক পরাশক্তি থেকে ভারত যখন বিশ্ব শক্তি হওয়ার নিরন্তর চেষ্টায় রত তখন রাষ্ট্রের চোখে দেশটির এক নম্বর শত্রু এখন দেশটির কিছু জনগন। এই শত্রু পাকিস্তান বা চীনের মতো বাইরের কোনো দেশ নয়, দেশের ভেতরেই রয়েছে এই শত্রু। বিশ্বের বৃহত্তম ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে নিজের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত। ভারতের মধ্যাঞ্চল তথা ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ, উড়িষ্যা, বিহার আর পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলছে এই যুদ্ধ।
অবশ্য ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্র উত্তর-পূর্ব ভারত আর কাশ্মীরে একইভাবে যুদ্ধ করছে অনেক আগে থেকেই । কিন্তু মধ্য ভারতের এই যুদ্ধের রূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাশ্মীর বা উত্তর-পূর্ব ভারতের যুদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধ হলেও এ অঞ্চলের গেরিলা যোদ্ধারা চান ভারতের বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থাটি বদলাতে। কারণ এই রাষ্ট্র তাদের নিজ ভূমে পরবাসী করে ফেলেছে। অরণ্যাঞ্চলে করপোরেট বাণিজ্যর নামে লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে দীর্ঘস্থায়ী বঞ্চনা আর নিপীড়নের মাধ্যমে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এই অঞ্চলে রয়েছে মূল্যবান খনিজ বক্সাইট, লৌহ আকরিক, টিন, গ্রানাইট, মার্বেল তামা, সিলিকা, ইউরেনিয়াম ও লাইমস্টোনসহ নানা ধরনের খনিজ সম্পদ। ভারত সরকার এখন অরণ্য রক্ষার বাহানায় এ অঞ্চলের হাজার বছরের বাসিন্দা ভূমিপুত্রদের উৎখাত করে কিংবা পাহাড়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে এসব খনিজ সম্পদ উত্তোলন করছে। আদিবাসী এ মানুষ দেখছে তাদের জীবন-জীবিকা অর্জনের অবলম্বন পাহাড় আর বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। তাদের জীবন-জীবিকার পথ হয়ে যাচ্ছে রুদ্ধ। মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত হারিয়ে ফেলছেন।
জঙ্গলে মাওবাদীদের ক্যাম্প
তাদের সামনে সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। বঞ্চিত মানুষের এই সংগ্রাম মাওবাদী আন্দোলন নামে পরিচিত। ভারতের প্রখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতি রায়ের মতে এই মাওবাদীরা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে সশস্ত্র গান্ধীবাদী। কারণ তাদের সংগ্রাম যেমন জীবন-জীবিকা রক্ষার সংগ্রাম, তেমনি বন পরিবেশ প্রকৃতি রক্ষারও সংগ্রাম। পশ্চিমবঙ্গের লালগড় থেকে শুরু করে ঝাড়খণ্ড উড়িষ্যা ছত্তিশগড় অন্ধ্রপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের বিশাল অরণ্যাঞ্চলের যারা ভূমিপুত্র তারা সবাই এখন মাওবাদী। ভারতের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরের দেয়া তথ্য মতে দেশের প্রায় ২০টি প্রদেশে মাওবাদীদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে । ভারতের ২২৩ জেলায় দুই হাজারের বেশি থানা ব্যাপক কিংবা আংশিকভাবে মাওবাদী হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরাই এখন তার এবং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের চোখে ভারতের এক নম্বর নিরাপত্তা হুমকি।
সম্প্রতি ছত্রিশগড়ের সুকমায় মাওবাদীদের হামলায় সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সি আর পি এফ) এর ১৩ জন সদস্য নিহত হয়। এরমধ্যে ২ জন ছিলো উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এ এলাকায় ২০১৩ সালের মে মাসে কংগ্রেস নেতা ও দলীয় কর্মীদের ওপর মাওবাদী হামলায় মারা যায় ২৭ জন। গত দুই মাস ধরে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছিলো। এর আগে কংগ্রেস শাসনামলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছত্তিশগড়ে মাওবাদীদের হামলায় ভারতের আধা সামরিক বাহিনী সিআরপিএফ’র ৭৬ জন সদস্য নিহত হয়।
মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণ আছে এমন এলাকাগুলোতে ভারতের প্রায় ৭৫ হাজার নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন আছে। যার মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে বিশেষ প্রশিক্ষিত ১৫ হাজার সদস্য রয়েছে। এ অবস্থায় মাওবাদীদের সশস্ত্র সংগ্রামের শক্তি বেড়ে চলার কারণে দিল্লিকেন্দ্রিক ভারতের কোনো কোনো মহল থেকে দাবি তোলা হয় যে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বিমান হামলা চালানো হোক। যদিও ভারতের বিমান বাহিনী প্রধান বলেছেন এখনো সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। ভারতের বিমান বাহিনী ১৯৬৬ সালে মিজো জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা আন্দোলন দমনের জন্য বিমান হামলা চালিয়েছিল। এসব আলোচনা থেকে বোঝা যায়, ভারতের শাসক শ্রেণীর মধ্যে মাওবাদীদের লড়াই-সংগ্রাম নিয়ে স্নায়ুবিক চাপ বাড়ছে। অপর দিকে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী এই লড়াই দমনের জন্য অস্ত্রসজ্জার কাজটি পুরোমাত্রায় চালিয়ে যাচ্ছে।
টহলরত সিআরপিএফ জওয়ান
ইসরাইল থেকে আনা হয়েছে লেজার রেঞ্জ ফাইন্ডার, থারমাল ইমেজিং ইকুইপমেন্ট এবং চালকবিহীন ড্রোন বিমান। সম্প্রতি পাহাড়ি এলাকা, জঙ্গল আর মরুভূমিতে ব্যবহারের জন্য ৫০ হাজার রাউন্ড গুলি চালাতে সক্ষম হেভি মেশিনগান কেনার চাহিদাপত্র দেয়া হয়েছে। বিদ্রোহ দমনের কাজে এই হেভি মেশিনগান ব্যবহৃত হবে (জেন্স ডিফেন্স উইকলি ৩১ মার্চ ২০১০ )। শুধু তাই নয়, ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ৩০ জন উচ্চপদস্থ ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তাকে গুপ্ত হত্যা চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। যাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে নেতৃস্থানীয় মাওবাদী নেতাদের হত্যা করে তাদের নেতৃত্বশূন্য করা। ছত্তিশ গড়ে মাওবাদী ও তাদের সমর্থক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন চালানোর জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় একটি মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হয়। সালওয়া জুদুম নামের এই আদিবাসীদের গ্রামের পর গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করেছে। অনেককে ধরে এনে শিবিরে আটকে রাখা হয়েছে। শুধু ছত্তিশগড়ে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা তিন লাখের বেশি। কিন্তু এভাবে নিপীড়ন চালিয়ে আন্দোলন দমন করা যায়নি বরং বেড়েছে। শুধু ছত্তিশ গড়ে ২০০৯ সালে মাওবাদীদের সাথে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর ৪২২টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে মারা যায় ৩৪৫ জন। এর মধ্যে পুলিশ ছিল ১২১ জন মাওবাদী ১৩৭ জন এবং সাধারণ গ্রামবাসী ৮৭ জন। (আনন্দ বাজার পত্রিকা ০৭ এপ্রিল ২০১০)।
ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ধারণা প্রায় ২০ হাজার মাওবাদী গেরিলা এখন নানা অঞ্চলে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। ভারতীয় শাসক শ্রেণীভুক্ত নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা শঙ্কিত এ কারণে যে, জম্মু কাশ্মীরে তিন হাজার সশস্ত্র যোদ্ধাকে মোকাবেলা করতে বিপুল পরিমাণ সৈন্য মোতায়েন করতে হয়েছে। এখন ২০ হাজার গেরিলা মোকাবেলা করা তাদের জন্য আরো বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি করেছে। ২০০৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ইন্ডিয়ার (মাওবাদী) সাথে একত্রিত হয় পিপলস ওয়ার গ্রুপ (পিডব্লিউজি) এবং মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টার। এরপর থেকে তাদের আন্দোলন বেগবান হতে থাকে। সশস্ত্র হামলার তীব্র রূপের কারণে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী গঠন করা হয়েছে। একের পর এনকাউন্টারের নামে বিচার বহির্ভূতভাবে অসংখ্য মাওবাদী আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক নিরীহ দরিদ্র যুবক যেমন আছে, তেমনি আদিবাসী যুবকরাও আছে। এর ফলে আন্দোলন দমন তো হয়নি বরং মাওবাদীদের জনভিত্তি আরো শক্তিশালী হয়েছে।
সম্প্রতি ভারতের প্রখ্যাত লেখিকা ও মানবাধিকার কর্মী অরুন্ধতি রায় মাওবাদীদের সাথে কয়েক দিন কাটিয়ে ‘ওয়ার্কিং উইথ দ্য কমরেডস’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। এ প্রবন্ধে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন নিপীড়নের যেমন চিত্র এসেছে তেমনি মাওবাদীদের যুদ্ধপ্রস্তুতি ও সামরিক প্রশিক্ষণের নানা বিবরণ এসেছে। অরুন্ধতি রায় প্রবন্ধের শুরুতে এক বর্ণনায় লিখেছেন In Dantewada, the police wear plain clothes and the rebels wear uniforms. The jail superintendent is in jail. The prisoners are free (three hundred of them escaped from the old town jail two years ago). Women who have been raped are in police custody. The rapists give speeches in the bazaar (http://www.outlookindia.com/article.aspx?264738)
আমরা দেখছি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট আন্দোলনে মাওবাদীরা সরাসরি ভূমিকা রাখছে। পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর নন্দিগ্রাম আর পূর্বমেদেনীপুরে স্থানীয় জনসাধারণের ভূমি রক্ষার যে আন্দোলন তাতেও মাওবাদীরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। মাওবাদীরা তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কার্যত বিকল্প শাসন পদ্ধতি চালু রাখার চেষ্টা করেছে। মাওবাদী নেতা কাটেশ্বর রাও কিষেনজি সে সময় ফ্রন্টলাইন পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন তাদের লক্ষ্য মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রিত একটি স্বাধীন এলাকা গঠন করা। যেখানে তারা বিকল্প শাসনব্যবস্থা কায়েম করবে। (ফ্রন্টলাইন ৬ নভেম্বর ২০০৯) ।
মাওবাদী সন্দেহে আটক কিশোর
মাওবাদীদের দমনে ভারতের নানামুখী পরিকল্পনার মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলার যে কৌশল গেরিলারা দেখিয়েছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে মাওবাদীরা যথেষ্ট প্রশিক্ষিত। ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীকে ফাঁদে ফেলে তাদের বলয়ের মধ্যে এনেছে। উদ্ধার করতে আসা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও নিহত হয়েছে। হামলার ধরন প্রমাণ করে এটা ছোটখাটো গেরিলাযুদ্ধ নয় বরং তা ছিল পরিকল্পিত যুদ্ধ কৌশলের অংশ। মাওবাদীদের হামলায় শুধু ভারতের আধা সামরিক বাহিনী সিআরপিএফ’র ৭৬ সদস্য মারা যায়নি, বিপুল পরিমাণ অস্ত্রও মাওবাদীদের হাতে চলে গেছে। ৬ এপ্রিলের এ হামলায় ছয়টি লাইট মেশিনগান, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরকসহ অনেকগুলো মর্টার, ৭০টির বেশি একে ৪৭ রাইফেল, ভারতীয় কিছু রাইফেল, বেশ কিছু পিস্তল, গ্রেনেড ও গোলাবারুদ।
অনেক ভারতীয় বিশ্লেষক দাবি করেন মাওবাদীরা নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ থেকে অস্ত্র পাচ্ছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোকে দায়ী করার এই প্রবণতা ভারতের নতুন নয়। বাংলাদেশে-ভারতের একটি বন্ধু সরকার ক্ষমতাসীন থাকার পরও তারা বাংলাদেশকে দায়ী করেছে। তবে নেপালের মাওবাদী গেরিলাদের সাথে আদর্শিক কারণে তাদের যোগাযোগ থাকা অস্বাভাবিক নয়। ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলেছেন, ভারতের মাওবাদী গেরিলারা নেপালের গেরিলাদের মতো লাইট ইনফেন্ট্রি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। যদি মাওবাদী গেরিলাদের সাথে ভারতের গেরিলাদের সত্যিকার যোগাযোগ ঘটে থাকে তবে তা ভারতের শাসক শ্রেণীর জন্য বড় ধরনের দুঃসংবাদের কারণ হবে। নেপালের মাওবাদীরা ভারত সমর্থিত রাজার সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে নেপালের রাজনীতিতে নিজেদের অনিবার্য হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
নেপালের পাহাড় আর বনে এই গেরিলারা যুদ্ধ করেছে। এই অভিজ্ঞতা যদি ভারতের গেরিলারা পেয়ে থাকে তবে উত্তর-পূর্ব ভারতের চেয়েও এই যুদ্ধের রূপ হবে ভয়ঙ্কর। সন্দেহ নেই ভারত সরকার এখন সর্বাত্মকভাবে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবে। কিন্তু এই সর্বাত্মক যুদ্ধের মাধ্যমে কী মাওবাদীদের পরাস্ত করা সম্ভব হবে? নিজ দেশের মানুষের সাথে এই যুদ্ধের ভবিষ্যতই বা কী? ভারতে বঞ্চিত মানুষের এই সংগ্রামের ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯৬৭ থেকে ৭৭ পর্যন্ত নকশাল বাড়ির আন্দোলন, পঞ্চাশের দশকে তেলেঙ্গানায় এবং ৮০র দশকে অন্ধ্র, বিহার আর মহারাষ্ট্রে এভাবে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। ভারতের শাসক শ্রেণী কঠোরভাবে এসব আন্দোলন দমন করেছে। কিন্তু সেই আন্দোলন বারবার নতুন শক্তি নিয়ে গড়ে উঠেছে।
মাওবাদী হামলায় নিহত কংগ্রেস নেতা
মূলত ভারতে পুঁজি বিকাশের সাথে সাথে বিরাট একটি জনগোষ্ঠী নির্যাতিত, নিপীড়ত এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। মিডিয়ায় যে চাকচিক্যময় ভারতকে দেখছি এর ভেতরের চিত্রটি খুবই করুণ। আমরা শুধু কিছু তথ্য দেখে নেই ইউএনডিপি কর্তৃক প্রকাশিত দারিদ্র্য সূচকে ভারতের অবস্থান ১৮২টি দেশের মধ্যে ১৩৪তম। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতের ৪৫ কোটি মানুষ দৈনিক ১ দশমিক ২৫ ডলারের কম আয়ে জীবনযাপন করে। কর্মক্ষম জনগণের মধ্যে ১০ শতাংশ বেকার। এখনো খাদ্যের জন্য মানুষকে লাইনে দাঁড়াতে হয়। ভারত সরকার এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা। বর্তমান বাজেটে সরকার স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় নির্ধারণ করেছে ২২ হাজার ৬৪১ কোটি রুপি, যা মোট জিডিপি’র মাত্র দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ সামরিক খাতে ব্যয় করা হবে মোট জিডিপি’র আড়াই শতাংশ।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে প্রতি বছর দূষিত পানি এবং বাতাসের কারণে মারা যায় প্রায় ৯ লাখ মানুষ। ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ঋণের টাকা শোধসহ এ জাতীয় কারণে ভারতে দুই লাখের বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছে। ২৪ লাখ মানুষ এইডসে আক্রান্ত। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তিন বছরের কম বয়সী ৪৬ শতাংশ শিশু পুষ্টিহীনতায় ভোগে। ভারতের প্রায় ৩৪ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। এর বিপরীতে ভারতের সমরপ্রস্তুতির দিকটি দেখা যাক। ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ২৬ ফেব্রুয়ারি সে দেশের ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন। বাজেটে গত অর্থবছরের চেয়ে সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। বাজেটে সামরিক খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৪৭ হাজার ৩৪৪ কোটি রুপি। আগামী বছরে সরকারের মোট ব্যয়ের ১৩ শতাংশ ব্যয় হবে সামরিক খাতে। গত অর্থবছরে এ ব্যয়ের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৪১ হাজার ৭০৩ কোটি রুপি। এর আগের অর্থবছরে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করেছিল ৩৪ শতাংশ। যা ছিল ভারতের ৬৪ বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। গত এক দশকে ভারতে সামরিক ব্যয় ছিল ৪৫ হাজার ৬৯৪ কোটি রুপি। এক দশক পরে অর্থাৎ ২০০৯-১০ সালে এসে সেই ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪১ হাজার ৭০৩ কোটি রুপি। ভারত সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তাতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ হারে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। আর এতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সামরিক খাতে বরাদ্দ গিয়ে দাঁড়াবে এক লাখ ৯২ হাজার ৩৯ কোটি রুপি। অথচ ভারতে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বিশ্বে সর্বাধিক।
ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে নিহত মাওবাদী গেরিলা
সমাজের হতদরিদ্র মানুষের জন্য ভারতের অর্থমন্ত্রী এর চেয়ে ভালো কোনো সান্ত্বনামূলক বাক্য ব্যবহার করতে পারেনি। ভারতের সমাজজীবনে এই ভারসাম্যহীনতা, বঞ্চনা আর নিপীড়নের অন্য নাম মাওবাদী আন্দোলন। ভারতের সমরাস্ত্র পাকিস্তান বা চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহারের আগে তা নিজ দেশের জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারতের মধ্যাঞ্চলের সশস্ত্র সংগ্রামের আসল কারণটি লুকিয়ে আছে সমরসজ্জা আর নাগরিক সেবার এই ব্যবধানের মধ্যে। সর্বাত্মক অভিযানের মাধ্যমে তা যতই দমনের চেষ্টা করা হোক না কেন তা বারবার ফিরে আসবে। ভারতের ভেতরের এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি শিগগিরই ঘটবে না।