আশাবাদী ছিটমহলবাসী
প্রধান প্রতিবেদকঃ লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনেই ছিটমহলবাসীর প্রত্যাশা পূরণ হবে এমনটিই আশা করা যাচ্ছে। ভারত সরকার তার সংসদে ছিটমহল বিনিময় ইস্যু সংক্রান্ত স্থল সীমান্ত চুক্তিটির অনুমোদন দেবেন বলে আশা করছেন ছিটমহলবাসী। আর এটি ভারত সরকার অনুমোদন দিলেই বাংলাদেশ ও ভারতের উভয় অংশে থাকা ৫১ হাজার মানুষের ভাগ্যে জুটবে নাগরিকত্ব। তারা পাবেন একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিক হওয়ার সব সুযোগ-সুবিধা।
এ দিকে আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে, ছিটমহল হস্তান্তর নিয়ে সব আপত্তি তুলে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার। মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র গত সপ্তাহের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্য সরকার চায় ৬৫ বছর ধরে ঝুলে থাকা বিষয়টির সমাধান হোক।
সরকারি সূত্রের খবর চিঠিতে বলা হয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময়ে নীতিগতভাবে কোনো আপত্তি নেই রাজ্য সরকারের। তবে ছিটমহলের যে অংশ পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হবে, সেখানে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রণয়ন ও পরিকাঠামো উন্নয়নে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। রাজ্য চায় সেই আর্থিক দায়িত্বের পুরোটাই নিক কেন্দ্র।
উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে বৃহস্পতিবার কোচবিহারের জনসভায় রাজ্য সরকারের এই অবস্থান পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সূত্র জানায়, এর আগে বেশ কয়েকবার আশ্বাসের পরও ছিটমহল বিনিয়ম সম্ভব হয়নি। কারণ ভারত সরকার তার সংসদে এই বিলটির অনুমোদন দিতে ব্যর্থ হন। তবে এবার এটি হবে বলে সম্প্রতি নেপালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন। এর আগে মনমোহন সিংয়ের সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে শীতকালীন, বাজেট এবং বর্ষাকালীন অধিবেশনে এটির অনুমোদন দেয়ার কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। ফলে ছিটমহলবাসী ভারতের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। তারা এখনো ভারতের দিকেই তাকিয়ে আছেন। কেননা, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আপত্তি নেই। ভারত সরকার সংসদ থেকে বিলটি পাস করলেই সমাধান হবে বহুল আলোচিত ছিটমহল সমস্যার।
সূত্র জানায়, ছিটমহল শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছু নাগরিকের রাতারাতি দেশহীন হয়ে পড়ার গল্প। আছে নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার ও জীবনের মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হওয়ার গল্প। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হলে ছিটমহল সমস্যা তৈরি হয়। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী এ নিয়ে কথা বললেও প্রকৃত অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। সেই ১৯৫৮ ও ১৯৭৪ সালে ছিটমহল বিনিময়ে চুক্তি স্বাক্ষর হলেও এতে কোনো সময় বেঁধে দেয়া ছিল না। ১৯৯২ সালে খালেদা-নরসিমা রাও আবার চুক্তি করেন। কিন্তু সে সময়ও চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ে কোনো সময় বেঁধে না দিয়ে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়। সর্বশেষ ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরকালে বিষয়টি আবারো আলোচনায় আসে। কিন্তু শুধু তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা এবং সেখানকার ছিটমহলের বাসিন্দাদের চলাচলের সাময়িক অসুবিধা দূর হলেও শেষ হয়নি ছিটমহলবাসীর কষ্ট। তবে সে সময়ের পর ছিটমহলবাসীর জনসংখ্যা গণনার কাজ শুরু এবং শেষ হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে। ভারতীয় ছিটমহলের বর্তমান জনসংখ্যা ৩৭ হাজার। বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোতে বর্তমান জনসংখ্যা ১৪ হাজার।
সূত্র জানায়, এর আগে অনেকবারই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করা হয় কিন্তু এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তবে, একবার তৎকালীন কংগ্রেস সরকার স্থল সীমান্ত চুক্তি বিলটির অনুমোদন দেয়ার জন্য সংসদে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু আসামের দুই এমপির তুমুল আপত্তির কারণে সেটি ভেস্তে যায়। তবে, এবার তেমন কোনো ঘটনা ঘটবে না এবং ছিটমহল বিনিময়ের জন্য যে স্থল সীমান্ত চুক্তিটির অনুমোদন দরকার সেটি হবে বলে মনে করেন ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহ-সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, এবার আশা একটু বেশিই করছি। তিনি এই চুক্তি অনুমোদনের পেছনে ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ভারতের নিজের প্রয়োজনেই এবার ভারত তার চুক্তিটি করবে। কেননা ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই উপমহাদেশের বাংলাদেশের বড় ভূমিকা রয়েছে। তবে ভারত সরকার ঠিক যে কারণেই এই চুক্তির অনুমোদন করুক না কেন এতে লাভবান যেমন হবে দুই দেশ তেমনি ভাগ্য বদল হবে ছিটমহলবাসীর। আর সেই আশায় তারা ক্ষণ গুনছেন।
ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহলের বাসিন্দা (যা অনুমোদন পেলে ভারতের অংশ হবে) জয়নাল আবেদীন জানান, তাদের ওখানে জনগণ মসজিদে মিলাদ করে দোয়া পড়েছে যেন এবার আর ভারত সরকার পিছিয়ে না পড়ে, কথা অনুযায়ী ঠিক সময়েই চুক্তিটির অনুমোদন হয়।
আনন্দবাজার জানিয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির জনসভার জন্য ছিটমহল লাগোয়া কোনো মাঠ বাছার নির্দেশ এসেছিল সপ্তাহ খানেক আগে। নেত্রীর জেড প্লাস নিরাপত্তার বহর অক্ষুণ্ন থাকে, প্রত্যন্ত এলাকায় এমন মাঠ বাছতে ঘাম ছুটে যায় প্রশাসন ও জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের। কিন্তু তখনই স্পষ্ট হয়েছিল, জনসভায় ছিটমহল নিয়ে কোনো বড় খবর ঘোষণা করতে চান মমতা। শেষ পর্যন্ত কোচবিহারের প্রত্যন্ত এলাকা ডাকুর হাটকে তার জনসভার জন্য বেছে নেয়া হয়েছে। এখানে তার মঞ্চের শ’দেড়েক মিটার পেছনেই বাংলাদেশি ছিটমহল করলা।
তার বক্তৃতা শুনতে যে ছিটমহলের বাসিন্দারাও আসবেন, মমতা তা বিলক্ষণ জানেন। থাকবেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি।
লোকসভা নির্বাচনের আগে কোচবিহারের জনসভাতেই মমতা প্রথম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ছিটমহল নিয়ে তিনি অবস্থান বদলাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, তিনি চান বাসিন্দাদের সুষ্ঠু পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করে ছিটমহল বিনিময় হোক।
বাংলাদেশের সাবেক ডেপুটি হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম সেপ্টেম্বরে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তার কাছেও ছিটমহলবাসীর দুঃখ-দুর্দশার কথা বর্ণনা করেন মমতা। সম্প্রতি নবান্নে বাংলাদেশের এমপিদের একটি দলের কাছেও মুখ্যমন্ত্রী বলেন, অসুখ হলে ডাক্তার-হাসপাতাল নেই, পড়াশোনার স্কুল-কলেজ নেই, থানা-পুলিশ নেই, নাগরিকত্বের পরিচয়টুকুও নেই ৬৫ বছর ধরে এই অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। ভাবা যায়?
গত সপ্তাহে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে স্থল সীমান্ত চুক্তির খসড়াটি অনুমোদিত হয়। তৃণমূল কংগ্রেসের দুই প্রতিনিধি সুগত বসু ও মমতাজ সংঘমিতা এতদিন বিরোধিতা করে এলেও এই বৈঠকে চুক্তির পক্ষেই সায় দেন।