এনবিআর ইস্যুতে কঠোর সরকার

- আপডেট সময় : ১১:১৬:১৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫ ৫ বার পঠিত

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চলমান আন্দোলন ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। জাতীয় স্বার্থবিধ্বংসী কর্মকা- থেকে আন্দোলনকারীরা সরে না এলে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে। পাশাপাশি উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ৫ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এদিকে এনবিআরের ৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এ ৬ কর্মকর্তার মধ্যে ৫ জনই এনবিআরে চলা সংস্কার ঐক্য পরিষদের নেতৃত্বাধীন আন্দোলন কর্মসূচির নেতৃত্বে আছেন।
অন্যদিকে গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে চলমান আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সঙ্গে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি দলের বৈঠকের পর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। রাজধানীর তেজগাঁওস্থ বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের পক্ষে সংগঠনটির সভাপতি ও অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার এবং ব্যবসায়ীদের পক্ষে বিসিআই সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বক্তব্য রাখেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, দেশের শীর্ষস্থানীয় চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এপেক্স ফুটওয়্যারের এমডি ও মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সহসভাপতি মির্জা আশিক রানা প্রমুখ।
ইতিপূর্বের খবরে বলা হয়, আন্দোলন স্থগিত না করায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আন্দোলনরতদের সঙ্গে বৈঠক করেননি। শাটউাডনের কারণে ইতোমধ্যেই ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। আমদানি পণ্য খালাস হচ্ছে না, জাহাজে উঠছে না রপ্তানিমুখী পণ্য। শুল্ক-কর আদায় হচ্ছে না। অর্থবছরের শেষ সময়ে বিপুল অঙ্কের বকেয়া রাজস্ব আদায়ের কথা থাকলেও আদায় হচ্ছে না। মোট কথা, পুরো রাজস্ব ব্যবস্থাপনা স্থবির হয়ে পড়েছে।
এনবিআর বিভক্তির জেরে সংস্থার চেয়ারম্যানকে অপসারণের দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরেই আন্দোলন করছেন এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আগের কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় তারা গতকালও দ্বিতীয় দিনের মতো কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করেন। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে তারা সারাদেশে সংস্থার সব কাস্টম হাউস, ভ্যাট কমিশনারেট ও আয়কর অফিসে কর্মবিরতি পালন করেন। এতে কোনো অফিসেই কাজকর্ম হয়নি। গ্রাহকরা সেবা নিতে পারেননি। সেবা না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়েন ব্যবসায়ীরা।
সংকট নিরসনে পাঁচ উপদেষ্টার সমন্বয়ে কমিটি গঠন
এনবিআরের কর্মকর্তাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট বিদ্যমান সংকট দ্রুত নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ উপদেষ্টার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল রবিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ কমিটির সভাপতি। সদস্য হিসেবে আছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন।
এ ছাড়া উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জনস্বার্থ রক্ষায় সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন সব কাস্টম হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনগুলোর সব শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যক পরিষেবা (এসেনশিয়াল সার্ভিস) ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অর্থ উপদেষ্টার বৈঠক
এদিকে গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বৈঠকের বিষয়ে তিনি বলেন, এনবিআর কিভাবে সংস্কার করা যায় সে বিষয়ে কমিটি আলাপ-আলোচনা করবে। তারা সবার কথা শুনবে।
এনবিআরের ৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান বিষয়ে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে মন্তব্য জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ওটা আমার কনসার্নড ডিপার্টমেন্ট না।
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান, আইসিসিবির সহসভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি একে আজাদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী, মেট্রো পলিটন চেম্বারের (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান, এমসিসিআইর সহসভাপতি ও ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও সিমিন রহমান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ প্রমুখ। বৈঠকে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানও উপস্থিত ছিলেন।
এনবিআরের চাকরি অত্যাবশ্যক সেবা, কাজে যোগ না দিলে কঠোর ব্যবস্থা
এনবিআরের সব শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যক সেবা ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে সংস্থাটির আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে ফেরার আহ্বান জানিয়ে সরকার বলেছে, কাজে যোগ না দিলে দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার কঠোর হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, অতি জরুরি আমদানি-রপ্তানি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কার্যক্রম চলমান রাখার জাতীয় স্বার্থে সরকার এনবিআরের আওতাধীন সব কাস্টম হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনগুলোর সব শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যক সেবা ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সরকার আশা প্রকাশ করে বলেছে, অনতিবিলম্বে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থলে ফিরে যাবেন এবং আইনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থবিধ্বংসী কর্মকা- থেকে সরে আসবেন। অন্যথায় দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বাজেট ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নমুখী কার্যক্রম পরিচালনার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো দুর্বল রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের রাজস্ব সংগ্রহ অনেক কম। এর মূল কারণ হচ্ছে, রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার নানা দুর্বলতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার সব অংশীজনের পরামর্শ অনুযায়ী এনবিআর পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সরকার গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছে, রাজস্ব সংস্কারের কাজকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী নজিরবিহীনভাবে ২ মাস ধরে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি এবং রাজস্ব আদায় কার্যক্রম অন্যায় ও অনৈতিকভাবে ব্যাহত করে আন্দোলনের নামে চরম দুর্ভোগ তৈরি করেছে, যা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সংস্কারের বিরোধিতা ছাড়াও অর্থবছরের শেষ ২ মাসে আন্দোলনকারীরা রাজস্ব আদায় কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছেন। এই তথাকথিত আন্দোলন পরিকল্পিত ও দুরভিসন্ধিমূলক, যা জাতীয় স্বার্থ এবং নাগরিক অধিকারের চরম পরিপন্থি। সরকারের পক্ষ থেকে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি বিবেচনায় নেওয়ার সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয় এবং আলোচনায় আসার আহ্বান জানালেও তারা তা অগ্রাহ্য করেন। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান না করে তারা আন্দোলনের নামে অনমনীয় অবস্থান নিয়ে ক্রমাগত দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করে চলেছেন। এর আগে এইচএম এরশাদের শাসনামলে ব্যাংক খাতের আন্দোলন দমাতে সরকার ব্যাংকিং সেবা অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করেছিল।
শাটডাউনে সারাদেশের বন্দরে অচলাবস্থা
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির কারণে পণ্য আমদানি-রপ্তানিসহ এনবিআরের সার্বিক কার্যক্রমে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা এই কর্মসূচির কারণে গত শনিবার থেকে ঢাকার এনবিআর ভবন থেকে শুরু করে সংস্থাটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, বেনাপোল ও সোনামসজিদ স্থলবন্দর এবং ঢাকা কাস্টম হাউসসহ দেশের সব কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এতে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সব ধরনের শুল্কায়ন কার্যক্রম বন্ধ।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে আইএমএফ
অন্যদিকে এনবিআরের সংস্কার ঘিরে কর্মকর্তাদের আন্দোলন এবং সার্বিক রাজস্ব সংস্কার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধিদের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের পর গতকাল রবিবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের মিশন প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও।
রাজস্বনীতি এবং ব্যবস্থাপনা আলাদা করতে আইএমএফের পরামর্শ রয়েছে। সরকার এ দুটি কার্যক্রম আলাদা করতে যে অধ্যাদেশ জারি করেছিল, তার বিরোধিতা করে এবং এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে সারাদেশে শাটডাউন কর্মসূচি ডাকে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। এতে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম চরমভাবে বিঘিœত হয়। এ অবস্থায় আইএমএফের দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে আইএমএফ মিশন প্রধান বলেন, আমরা যেসব সংস্কারের তাগিদ দিচ্ছি, তা নিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আমাদের হালনাগাদ পরিস্থিতি জানাচ্ছেন। জনগণকে এটি স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন যে, সরকার যেসব প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা দরকার।