পলিশ করা মিনিকেট চাল নিয়ে কারসাজি!

- আপডেট সময় : ১১:২২:০২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫ ৫১ বার পঠিত

দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে দাম বেড়েছে ৮ থেকে ১০ টাকা
প্রতি বছর রমজানের সময় সাধারণত চালের দাম কম থাকে। কারণ, এ সময় চালের চাহিদা কমে যায়। বিশেষ করে রমজানের মাঝামাঝিতে এসে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দামই তুলনামূলক কম থাকে। কিন্তু এবার চালের দাম না কমে উলটো বেড়েছে। বিশেষ করে মিনিকেট চালের দাম।
গতকাল সোমবার রাজধানীর কাওরান বাজার, বাবুবাজার ও তুরাগ এলাকার নতুন বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মিনিকেট চালের দাম কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সরু চাল নাজিরশাইলের দাম তেমন না বাড়লেও ভালো মানের এই চালের কেজি ৮৫ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় মিনিকেট চালের সরবরাহ কম। যে কারণে এই চালের দাম বাড়তি। এ প্রসঙ্গে বাজার সংশ্লিষ্ট-ব্যক্তিরা বলেছেন, মিনিকেট নামে ধানের কোনো জাত নেই। তাই মিনিকেট নামে কোনো চালও নেই। ব্রি ধান-২৮, ব্রি ধান-২৯, ব্রি হাইব্রিড ধান ও কাজল লতার মতো মোটা জাতের ধান থেকে উৎপাদিত চাল পলিশ করে মিনিকেট নামে ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাজারে এখন এসব ধানের সরবরাহ কম। আগামী এপ্রিলের শেষ নাগাদ বোরো মৌসুম শুরু হলে এসব জাতের ধানের সরবরাহ বাড়বে। তখন মিনিকেট নামের এই চালের দাম কমে আসবে।
তারা বলেন, মিনিকেট চালের নামে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। কারসাজি করে বেশি দামে ভোক্তাদের কাছে এই চাল বিক্রি করা হচ্ছে। গতকাল বাজার ঘুরে দেখা যায়, মানভেদে প্রতি কেজি মিনিকেট ৭৮ থেকে ৮৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। যা দুই সপ্তাহ আগে ৭০ থেকে ৭৫ টাকার মধ্যে পাওয়া গেছে। এছাড়া, বাজারে অন্যান্য চালের মধ্যে মানভেদে প্রতি কেজি নাজিরশাইল ৭৯ থেকে ৮৫ টাকা ও মোটা চাল ইরি/স্বর্ণা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীতে খুচরা ও পাইকারি বাজারের মধ্যে অন্যতম কাওরান বাজার। এই বাজারের মেসার্স মান্নান রাইস এজেন্সির মো. মান্নান বলেন, অন্যান্য চালের দাম তেমন না বাড়লেও মিনিকেট চালের দাম বেশ বাড়তি। তিনি বলেন, গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ধাপে ধাপে প্রতি কেজি মিনিকেট চালে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
তিনি বলেন, বাজারে এখন এই চালের সরবরাহ কম। যাদের কাছে মজুত আছে, তারা অল্প অল্প করে মিনিকেট চাল বাজারে ছাড়ছেন।
একই কথা জানালেন, এই বাজারের মেসার্স মতলব ট্রেডার্স ও আল আমিন ট্রেডার্সের বিক্রেতারাও। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বিভিন্ন নিত্যপণ্যের বাজারদর নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে। সংস্থাটির প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত বছর এই সময় রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট/নাজিরশাইল বিক্রি হয়েছে ৬২ থেকে ৭৫ টাকায়। আর মোটা চাল ইরি/স্বর্ণা বিক্রি হয়েছে ৪৮ থেকে ৫২ টাকায়। রাজধানীতে চালের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বাবুবাজার পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, বাজারে মিনিকেট চালের সরবরাহ কম। তাই দাম নেই? বাড়তি।
আসলেই কি মিনিকেট নামে কোনো চাল আছে?
দেখতে সরু ও ঝকঝকে চেহারা এবং দামে চড়া এই চালটির বাজারে ভোক্তাদের কাছে বেশ কদর। কিন্তু মিনিকেট নামে আদৌ কোনো ধান আছে কিনা তা নিয়ে রয়েছে নানা মত। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) সূত্র জানিয়েছে, মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই। ব্রির উদ্ভাবিত বিভিন্ন সরু আকৃতির ধান থেকে উৎপাদিত চাল পলিশ করে বাজারে মিনিকেট নামে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে ব্যবসায়ী ও মিলমালিকরা বলছেন, চাল ছাঁটাইয়ের কোনো মেশিন নেই।
তাদের দাবি, উত্তরাঞ্চলে আবাদ হওয়া জিরাশাইল ধান কৃষকরা মিনিকেট নামে বাজারে বিক্রি করেন। এ ধান থেকে তৈরি হয় মিনিকেট চাল। কেউ কেউ দাবি করেছেন, বাজারে মিনিকেট নামে যে চাল পাওয়া যায়, সেটার উৎপত্তি ভারতের এক ধরনের ধানের বীজের প্যাকেট থেকে। ‘মিনিকেট’ শব্দটি এসেছে ইংরেজি ‘মিনিকিট’ থেকে, যা কোনো ধানের জাত নয়। এটা এক ধরনের প্রোগ্রাম বা কর্মসূচি। ভারত সরকার কৃষকদের উপহার হিসেবে যে প্যাকেটে ধানের বীজ দিত, তা ‘মিনিকিটা নামে প্রচলিত। এ জাতের আবাদ বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায়ও শুরু হয়। পরে তা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে মোটা ধান পলিশ করে মিনিকেট বানানোর এ প্রত্রিয়া বন্ধে আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে মিনিকেট নামে কোনো চাল বাজারজাত না করতেও ব্যবসায়ী ও মিলমালিকদের নির্দেশ দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাজারে দেদার মিনিকেট নামে চাল বিক্রি হচ্ছে।
গতকাল খাদ্য মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, মিনিকেট মূলত মেশিন প্রসেসড রাইস। বিভিন্ন মোটা জাতের ধান থেকে উৎপাদিত চাল পলিশ করে মিনিকেট নামে ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন আমন মৌসুমের শেষের দিকে। এবং বোরো মৌসুম শুরুর মধ্যবর্তী সময়। প্রতি বছর এ সময় চালের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পায়। তবে এ বছর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পদক্ষেপের কারণে চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। চলতি মার্চ ও এপ্রিল মাসে সরকার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, ভিজিডি, ওএমএস ও টিসিবির মাধ্যমে প্রায় ৭ লাখ টন চাল বিতরণ করা হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সাড়ে ৮ মাসে মোট ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪০০ টন চাল আমদানি হয়েছে। সবমিলিয়ে চালের কোনো সংকট নেই। মিনিকেটের মতো চালের মূল্যবৃদ্ধি বাজারে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।